‘Lady with the lamp’ সারা বিশ্বে বিপুলভাবে সমাদৃত একটি নামকরণ। বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত, সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত বিশাল জনগোষ্ঠীর ঝাপসা চোখের সামনে আলোর ঝর্ণাধারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন যে মহীয়সী নারী, ওনার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ এই উপাধি ‘লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প’। ১৮২০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্ম নেয়া ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’ এর সমস্ত জীবনটাই মানুষের জন্য ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। মৃত্যুর ১২২ বছর পরেও এই মহান নারীকে মানুষ পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। কালের বিবর্তনে বাংলাদেশও পেয়েছে তেমনি এক নারী যিনি আলোকবর্তিকা হাতে অবতীর্ণ হয়েছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জাতিকে আলোর পথ দেখাতে, পিছিয়ে পড়া একটা মানবগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে। যার শিরায় প্রবাহিত জাতির জনকের উষ্ণ রক্তধারা। শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা সবকিছু ছাপিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন একটি নামে ‘নেত্রী’। দাসত্বের শৃক্সখল ভেঙে মুক্তিপাগল একটা জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু‘, তারই ধারাবাহিকতায় একটি জাতির মাথাতুলে দাঁড়াবার প্রেরণা দাত্রী হয়ে উঠলেন ‘নেত্রী’।
২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়েই ‘নেত্রী’ সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ নামক দেশটাকে বিশ্বের বুকে দাঁড় করাতে হলে টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, সেই স্বপ্নের শাব্দিক পরিচয় ‘ভিশন–২১’। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে নেত্রী সত্যিকার অর্থেই আলোকবর্তিকা হাতে নারী রূপেই অবতীর্ণ হলেন। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পূর্বে চট্টগ্রামবাসীকে দেয়া প্রস্তুতি অনুযায়ী নিজ হাতে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার যে দায়িত্ব, তা বাস্তবায়নে ‘নেত্রী’ সততা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে আপোষহীন আবদুচ ছালামের হাতেই আলোকবর্তিকা তুলে দিলেন। পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ধারক আবদুচ ছালাম হয়ে উঠলেন একজন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। আবদুচ ছালাম চির অবহেলিত চট্টগ্রাম শহরকে নতুন আলোয় রাঙিয়ে দিতে মাঠে নেমে পড়লেন। কিন্তু স্বপ্নদেখা, পরিকল্পনা, কর্মপন্থা নির্ধারণ শব্দগুলো পরপর লিখে ফেলা যত সহজ বাস্তবায়ন করা হাজারগুন কঠিন, সেই কঠিন কাজগুলো সুনিপুণ হাতে সম্পাদন করেছেন আবদুচ ছালাম।
‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ নামক সীমিত পরিধির একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়ে আবদুচ ছালাম ৪০ বছর ধরে অযত্ন অবহেলায় পিছিয়ে পড়া চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজাবার কঠিন সংগ্রাম শুরু করেন। নিজের অধীনস্থ সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। আবদুচ ছালাম সিডিএ এর চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা ১০ বছর আক্ষরিক অর্থেই চট্টগ্রামের ‘উন্নয়ন রেনেসাঁস’। রেনেসাঁস এর সময় ইউরোপ বাকী বিশ্ব থেকে ১০০ বছর এগিয়ে যায়। একথা অনস্বীকার্য আবদুচ ছালামের ১০ বছরে চট্টগ্রামে অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হয়, স্বাধীনতার পর হতে ১৯৭১–২০০৮ পর্যন্ত সময়ে তার সিকিভাগও হয়নি। দায়িত্বের প্রথমেই আবদুচ ছালাম নজর দেন যোগাযোগ ব্যাবস্থার ওপর। তিনি পাঁচশত এর বেশি উঠান বৈঠক করেছেন, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা পৌঁছে দিয়েছেন, কিন্তু কোথাও বাস্তুহারা মানুষের কান্নার রোল পড়েনি। উনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন শহরটা শহরবাসীর।
কোথায় হাত দেননি আবদুচ ছালাম? কাপাসগোলা হতে চকবাজার রোড সম্প্রসারণ, চকবাজার হতে আন্দরকিল্লা রোড সম্প্রসারণ, কালুরঘাট হতে বহদ্দারহাট রোড সম্প্রসারণ, আন্দরকিল্লা হতে লালদীঘি রোড সম্প্রসারণ, কোতোয়ালী মোড় হতে ফিরিঙ্গী বাজার রোড সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মান, সদরঘাট রোড সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মাণ, ডিসি রোড ও পাঠানটুলী রোড সম্প্রসারণ, কর্ণফুলী মার্কেট হতে এক্সেস রোড সম্প্রসারণ ও দুইপাশে ড্রেন নির্মাণ, কমার্স কলেজ রোড সম্প্রসারণ, অক্সিজেন হতে প্রবর্তক মোড় রোড, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড, সাগরিকা রোড, অক্সিজেন হতে মুরাদপুর হয়ে অলি খাঁ মসজিদ রোড, অক্সিজেন হতে কুয়াইশ রোড সম্প্রসারণ (বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকা ও কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা রোড সম্প্রসারণ, মোহরা এনেক্স শিল্প এলাকা রোড সম্প্রসারণ ও মোহরা এলাকার ২০ কিলোমিটারের অধিক রাস্তার কাজ তিনি সম্পাদন করেন। ‘নেত্রীর’ কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাওয়ার ফলে চট্টগ্রাম শহরকে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাপমুক্ত করতে আবদুচ ছালাম বেশকিছু যুগান্তকারী প্রকল্প হাতে নেন। বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভার, মুরাদপুর হতে লালখান বাজার পর্যন্ত আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার, কদমতলী ফ্লাইওভার, দেওয়ানহাট ওভারপাস নির্মাণ করে আবদুচ ছালাম চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যাবস্থায় আধুনিকতার ছোঁয়া দেন। সাগরপাড়ের সিটি আউটার রিং রোড, ফৌজদার হাট হতে বায়েজিদ বাইপাস রোড, চন্দনপুরা হতে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক (বাকলিয়া এক্সেস রোড) বাস্তবায়নের ফলে চট্টগ্রাম শহরকে যানবাহনের বাড়তি চাপ থেকে অনেকটা মুক্ত রেখেই উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে রাজধানী ঢাকা তথা সারাদেশের যোগাযোগ ব্যাবস্থা সহজতর করা হয়েছে। লালখান বাজার থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত ১৬ কিঃমিঃ দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ তিনিই শুরু করেছিলেন, কিন্তু সে প্রকল্প এখনো শেষ না হওয়াতে চট্টগ্রামবাসী তার সুফল পেতে শুরু করেনি। কর্ণফুলীর তীরে চাক্তাই খালের মুখ হতে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত ৮–৫০ কিঃমিঃ দীর্ঘ রিং রোড কাম শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প এখনো বাস্তবায়নাধীন। এসব মেগাপ্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রতিটা মেয়র নির্বাচনের পূর্বে চট্টগ্রাম শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং নির্বাচনের পরে অপারগতা স্বীকার করা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছিল। এই অভিশাপ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আবদুচ ছালাম আরও একটি মেগাপ্রকল্প প্রণয়ন করেন। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখনো বাস্তবায়নাধীন। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা এই তিন খাতেই আবদুচ ছালাম মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কল্পলোক ও অনন্যা আবাসিক প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন, নারী শ্রমিকদের জন্য সিমেন্ট ক্রসিংয়ে গড়ে তুলেছেন ডরমেটরী, সিডিএ স্কয়ার ফ্ল্যাট, দেওয়ানহাট ফ্ল্যাট, কাজীর দেউড়ী ফ্ল্যাট তারই চেষ্টার ফসল। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন আবদুচ ছালাম। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ম্যুরাল ও কোর্ট হিলে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন তিনি। তারই পরিকল্পনায় অনন্যা আবাসিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ‘এভারকেয়ার হাসপাতাল’। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ এর আধুনিকায়নে কাজ করেন। তিনি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের শরীরচর্চার কথা বিবেচনা করে অবহেলিত প্যারেড মাঠে ওয়াকওয়ে নির্মাণ সহ সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কাজ করেন, জরাজীর্ণ জিমনেসিয়ামটিকে সংস্কার করেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ ও সিডিএ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ।
তিনি ১০টি বছর ছুটে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রাম শহরের পথে প্রান্তরে, আর আলোয় সজ্জিত করেছেন আমাদের প্রিয় চট্টগ্রামকে। তার হাতেই ১০ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্ম সম্পাদন হয়েছে যা একটা জেলা শহরের জন্য অভাবনীয়। এ অভুতপূর্ব উন্নয়ন চট্টগ্রামবাসীর প্রতি প্রিয় নেত্রীর নিগুঢ় ভালোবাসা ও আবদুচ ছালামের প্রতি অগাধ আস্থার ফসল।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী