আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস

মোরশেদুল আলম কাদেরী | শুক্রবার , ১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আজ ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি প্রতিবছর ১ অক্টোবর পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯০ সালে। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয়।
প্রতিবছর দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘উরমরঃধষ ঊয়ঁধষরঃু ভড়ৎ অষষ অমবং’ অর্থাৎ ‘ডিজিটাল সমতা সকল বয়সের প্রাপ্যতা’ ।
অতিমারী কোভিড-১৯ মানুষের জীবন-জীবিকাকে প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত করে চলেছে। করোনায় বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং করছে। এ মহামারীতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠী। ডিজিটাল সমতা সকল বয়সের প্রাপ্যতার কথা বলা হয়েছে। প্রবীণদের জন্য আদৌ এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা আমরা জানি না।
প্রবীণ শব্দ উচ্চারণ মাত্র আমাদের চোখের সামনে যে-ছবিটা ভেসে ওঠে তা হলো একজন শুভ্র-কেশধারী মানুষ যিনি বয়সের ভারে এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাতর। কেউ কেউ অত্যন্ত অসহায়ভাবে জীবন যাপন করে থাকেন। আমরা তাদের সম্মান মর্যাদা কতখানি দিয়ে থাকি জানি না, তবে অযত্ন অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারলে যেন বাঁচি।
আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। এ প্রবীণ জনগোষ্ঠী পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে, তার খবর কেউ রাখে বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণরাই এই দেশ, সমাজ তথা পরিবারের জন্য একসময় বিরাট অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলেছে। বার্ধক্যের স্বাদ সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। জন্মিলে যেমন মৃত্যু অনিবার্য, তেমনি বেঁচে থাকলে প্রত্যেক মানুষকেই বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এ থেকে কোনো নিস্তার নেই। বিশ্বের অনেক দেশসহ সার্কভুক্ত কোনো কোনো দেশে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। এদিক থেকে আমাদের দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ এবং পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও এ আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন তেমনভাবে হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল-
‘দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা’। কিন্তু এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রবীণরা কি সেই মর্যাদাটুকু পেয়েছে? রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, গণপরিবহন- কোথাও কি প্রবীণরা সেই সুবিধাটুকু পেয়েছে?
প্রতি বছরই প্রবীণ দিবসে নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কতটুকু প্রয়োগ করা হয়? প্রকৃতপক্ষে পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের বোঝা মনে করা হয়। তাদের সম্মান, মর্যাদা কিংবা কষ্টের কথা কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলো তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশ অনেক বেশি উপকৃত হতে পারত।
ব্রিটিশ সরকার এ উপমহাদেশে ১৯২৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন চালু করে। প্রায় ৭২ বছর পর ১৯৯৭ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার বয়স্কভাতা চালু করে। প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোটি, ২০১৪ সালে ১৩০৬ কোটি, পরবর্তী বছরে ১৪৪০ কোটি, ২০১৯-২০ বাজেটে ২০৬৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করা এবং জাতীয় নীতিমালায় প্রবীণ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করা। এক সমীক্ষায় জানা যায় পারিবারিক সহায়তা, পেনশন ও বয়স্ক ভাতার আওতাধীন প্রবীণ ছাড়াও দেশের প্রায় দুইতৃতীয়াংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী অবহেলা ও অযত্নের শিকার। এ জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। ফলে অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ৬০ বছর পার হলেই প্রবীণের ঘরে নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হয়ে উঠেছেন তারা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী জন্মের পর বাংলাদেশের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০.০৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের আয়ু ৭০.০৬ বছর, নারীর ৭১.৯৮ বছর। আর ৬০ বছর বয়সের উর্ধ্বে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ বসবাস করছে। এদের কেউ কেউ একশ বছরের মতো বয়সেও দীর্ঘ জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে নারী প্রবীণরা দীর্ঘজীবী হলেও তাদের অধিকাংশই মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। এ দুঃসহ জীবন যাপন শুধুমাত্র অসহায়ত্ব ও দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছু নয়।
২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীন বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন। এই সম্মেলনে যে এগারোটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় সেগুলো হচ্ছে-
(১) সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন, (২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসঙ্ঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন, (৩) নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন, (৪) জীবনব্যাপি এবং শেষ জীবনেও সচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে
(৫) প্রবীণরা কোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয় বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ, (৬) প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে, (৭) জেন্ডারকেন্দ্রিক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার; (৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নিভর্রশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান, (৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা ১০) প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা, (১১) উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান, (১২) আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়া। এই সম্মেলনে যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো: (ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন, (খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি; (গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
আমাদের দেশে সরকারিভাবে বর্তমানে ২৪ লক্ষ ৭৫ হাজার দুস্থ নারী ও পুরুষকে বয়ষ্কভাতা হিসেবে মাসে তিনশত টাকা দেয়া হয়। ছয়টি সেভ হোম বা শান্তিনিবাস আছে, তবে অব্যবস্থাপনায় ভরা। বেসরকারিভাবে দেশে কিছু বৃদ্ধাশ্রম আছে, যেখানে সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের অবহেলা, সন্তানদের উপক্ষোয় অশ্রুপাত ও হৃদরোগে মৃত্যু প্রবীণদের একমাত্র নিয়তি। প্রবীণদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের অসম্মান কখনও বাঙালির মূল্যবোধ হতে পারে না। এছাড়া দারিদ্র ও নিঃসঙ্গতা প্রবীণদের কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। আমাদের দেশে প্রবীণ নীতিমালা আছে। প্রবীণদের সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। পৃথিবীর উন্নত দেশে ও আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতেও এই সম্মানের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। একারণেই সেখানে যানবাহনে যাতায়াতে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে, ব্যাংকের লেনদেন কার্যক্রমে প্রবীণদের বিশেষভাবে সহযোগিতা দেবার ব্যবস্থা আছে। ‘সিনিয়র নাগরিক’ ঘোষণা করলে এসব সুযোগ তো পাওয়া যাবেই এবং সমাজের অবহেলা, তরুণদের কাছে অসম্মান ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হবে না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে তাদের সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, মর্যাদা দেয়া ও সহায়তা করা আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিৎ।
আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। এ প্রবীণ জনগোষ্ঠী পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে, তার খবর কেউ রাখে বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণরাই এই দেশ, সমাজ তথা পরিবারের জন্য একসময় বিরাট অবদান রেখেছেন। আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ, এটা চিন্তা করে প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করতে এবং জাতীয় নীতিমালায় প্রবীণ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করা খুবই প্রয়োজন। প্রবীণদের জীবনের মানোন্নয়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে আমাদের দেশেও বাস্তবায়ন করা হোক- আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এটাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখা, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফরগিভনেস ইজ এ ফ্রিডম
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা