আত্মহত্যা : অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু

মুহাম্মদ মুসা খান | মঙ্গলবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন হৃদয়ে মাঝে যদি স্থান পায়’।
কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছিলেন,
‘নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি-গান,
ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন প্রাণ।
এ বিশ্বের সব আমি প্রাণ দিয়ে বসিয়াছি ভাল,
আকাশ বাতাস জল, রবি, শশী, তারকার আলো’।
শুধুমাত্র কবি রবীন্দ্রনাথ ও কবি গোলাম মোস্তফাই নয়, কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও দুনিয়ার সব মানুষেরই এই সুন্দর ভুবনে বেঁচে থাকার আকুতি দেখা যায়। অথচ এই সুন্দর ভুবন হতে কিছু মানব সন্তান স্বেচ্ছায় বিদায় নেন, যাকে আমরা আত্মহত্যা বলি। আত্মহত্যা কারও কাম্য না হলেও প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার সংবাদ শোনা যায়।
আত্মহত্যার কারণ : কেন এই আত্মহত্যা! মূলতঃ ’মানসিক চাপই’ আত্মহত্যার মূল কারণ। এই মানসিক চাপ আসতে পারে-হতাশা, ব্যর্থতা, পরিবারের সদস্যদের অবহেলা ও দুর্ব্যবহার, অপরাধবোধ, সম্মানহানি, দারিদ্র্যতা/অভাব, বিষণ্নতা, মিথ্যা অপবাদ, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, হীনমন্যতাবোধ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, যৌতুক, চাহিদা অপূরণ, দেনা শোধে ব্যর্থতা, মানসিক রোগ (সিজোফ্রোনিয়া), মাদকাসক্তি, আত্মবিশ্বাসের অভাব, বিষণ্নতা, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, প্রেম প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি কারণে। এসব চিন্তার কোন একটি যখন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় এবং সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়। আর তখনই সে ব্যক্তি আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়। তাঁর ধারণা হয়, আত্মহত্যাই মুক্তির পথ। পাশ্চাত্যে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধদের মধ্যে একাকীত্বের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ইতালীয় কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস বলেছেন, ‘আত্মহত্যা করার জন্য কারো কারণের অভাব হয় না’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মোঃ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আত্মহত্যার অন্যতম কারণ-মানসিক চাপ, চাপ সামলাতে না পারলে তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই- তাঁর কাছে সহজ মনে হয়”। মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রওশন আরা রানী বলেন, ‘হতাশা ও মানসিক চাপই আত্মহত্যার অন্যতম কারণ’।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, মানব মস্তিষ্কের সেরিব্রোস্পাইনাল তরলের মধ্যে ‘৫-হাইড্রোঙি ইনডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড’ নামের একটি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ কমে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। আত্মহত্যা করার জন্য প্রথমে বিক্ষিপ্ত ভাবে মনের মধ্যে চিন্তা আসে। এর পর বিক্ষিপ্ত চিন্তা গুলো বার বার আসতে থাকে। আত্মহত্যার চিন্তা তাঁর স্বাভাবিক কাজ কর্মের উপর প্রভাব ফেলে। তাঁর আত্মহননের ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয় এবং বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়। তখন সে মনে করে মরে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়”।
আত্মহত্যার ইংগিত ঃ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারি সাধারণ কথোপকথনে অনানুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুর কথা বলে, মরে যেতে চায়-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে। আত্মহত্যা বা মৃত্যু বিষয়ক কবিতা-গান লেখা বা শোনা বা পড়া। প্রায়ই হাত-পা কাটে, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খায়। বিষণ্নতার লক্ষণ (মনমরা হয়ে থাকে, নিজেকে সব বিপর্যয়ের জন্য দোষী মনে করে)।
মাদকাসক্তির লক্ষণ (চিন্তা আর আচরণের পরিবর্তন, রাত জাগা, দিনের বেলা ঘুম, মিথ্যা বলা, টাকার চাহিদা বেশি, আগ্রাসী আচরণ ইত্যাদি)। বন্ধুবান্ধব, পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সামাজিকতা এড়িয়ে চলে, একা একা থাকে। নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ভাইবোন বা বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকে। পড়ালেখা, খেলাধুলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেওয়া, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা। বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনদের বলা-আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না।
আত্মহত্যার চিত্র ঃ বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার চিত্রকে ভয়াবহই বলা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ”প্রিভেন্টিং সুইসাইড ঃ অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনানস ২০১৭” জরীপ অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে ৬০ শতাংশ। বর্তমানে ১৫ হতে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে। প্রতি বছর ৪০ লাখ ছেলে-মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১০ হাজারের অধিক মানুষ আত্মহত্যা করেন। ২০১৬ ও ২০১৭ সনে যথাক্রমে আত্মহত্যা করেছিল ১০ হাজার ৭৪৯ জন ও ১০ হাজার ২৫৬ জন (ডিএমপি’র দেয়া তথ্য)। এ হিসাবে দেখা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করেন। জাপানে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর চেয়ে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার বেশী বলে জানা গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আশংকা করছে, ২০২০ সন নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করবেন।
আত্মহত্যা সম্পর্কে ধর্ম কি বলে ঃ আত্মহত্যাকে ইসলাম ধর্মে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সূরা আন নিসা’র ২৯-৩০ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে, অন্যায় ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাঁকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- কোনো ব্যক্তি যেই জিনিস দ্বারা আত্মহত্যা করে, কেয়ামতের দিন তাঁকে সেই জিনিস দ্বারাই শাস্তি দেয়া হবে (নাসাই, তিরমিজি)। হিন্দুধর্মেও আত্মহত্যা ‘মহাপাপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রামকৃষ্ণও বলেছেন, ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, ফিরে ফিরে সংসারে আসতে হবে, আর এই সংসার-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে’। তাঁদের কিছু ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর পরিণতি হলো-দানব রূপে আবির্ভাব। ইহুদিদের ধর্ম মতে ‘আত্মহত্যা একটি জঘন্য ধরনের পাপ। এটি এমন কাজ, যা মানবজীবন যে স্বর্গীয় দান-তা অস্বীকার করে। এবং মনে করা হয় এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জীবনকালকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য তার মুখমন্ডলে চপোটাঘাত’। খ্রিষ্টানদের বাইবেলে ‘আত্মহত্যা নিষিদ্ধ বিষয়ে-স্পষ্টভাবে কোন কিছু বলা না হলেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মতত্ত্ব মতে-আত্মহত্যা নিরপেক্ষ ভাবে একটি পাপ, যা নিজেকে হত্যা না করার নৈতিক আদেশের লঙ্ঘন। বৌদ্ধ ধর্মেও ‘আত্মহত্যাকে নেতিবাচক কাজ (মন্দ কাজ) গণ্য করে জীবন নাশ হতে নিজেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে”। আমরা লক্ষ্য করেছি, স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা ছাড়াও অন্যের প্ররোচনায় বা যন্ত্রণায়ও মানুষ হত্যা করে। এ ধরনের প্ররোচনা দানকারিকে আমাদের দেশের আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। আত্মহত্যার প্ররোচনা বা সহায়তা দানকারিকে দন্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদন্ড ও আত্মহত্যার চেষ্টাকারিকে দন্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী এক বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
প্রতিকার ঃ আত্মহত্যা সম্পূর্ণ ভাবে রোধ করা অসম্ভব বিষয় বলেই অনেকে মনে করেন। তবে আত্মহত্যা কমিয়ে আনা বা হ্রাস করা বা আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনা অসম্ভব কোন বিষয় নয়। আত্মহত্যার কারণ গুলো আমরা যদি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করি, তাহলে কারণের প্রতিকারও খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এরজন্য প্রয়োজন সরকারি, বেসরকারি ও পারিবারিক উদ্যোগ। যে কোন ধরণের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইংগিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ-এর শরণাপন্ন হতে হবে (কবিরাজ-বৈদ্য নয়)। অস্বাভাবিক আচরণকারীদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, তাঁদেরকে সহানুভূতি জানাতে হবে।
আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করে থাকি যে, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলে বা ফেল করলে পিতা-মাতার বকুনীর কারণে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। অথচ পৃথিবীর অনেক বড় বড় দার্শনিক/বিজ্ঞানী পরীক্ষায় ফেল করার পরও দার্শনিক/বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ভাল ফলাফলের জন্য তাঁদেরকে চাপ সৃষ্টি না করে, বকুনি না দিয়ে, বরং বলা উচিত যে, ‘এবার ফল ভাল হয়নি, আগামীবার ভাল করতে হবে”। তাহলে সন্তানের উপর চাপ কমবে, আত্মহত্যা ও অধিকাংশ হ্রাস পাবে। তাছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। পরিবার হলো সন্তানের জন্য বড় শক্তি, আর পিতা-মাতা, ভাই-বোন হলো সবচেয়ে বড় আপনজন-পরিবারের সবার আচরণের মধ্যে এই বিষয়টির প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমাদের দেশে আত্মহত্যার আরেকটি প্রধান কারণ যৌতুক প্রথা। যৌতুকের জন্য অত্যাচারের কারণে প্রতিবছর শত শত নারী আত্মহত্যা করেন। অথচ যৌতুক প্রথা আইনত অন্যায়। যৌতুক বিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ আত্মহত্যাকে অনিবার্যভাবে হ্রাস করবে। সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমে আত্মহত্যার নেতিবাচক ও খারাপ দিকগুলো ব্যাপক ভাবে তুলে ধরতে হবে। একটি বিষয় সবার উপলব্ধিতে আনতে হবে যে, আত্মহত্যা সমাধান নয়। বরং আত্মহত্যার পর আরও অনেক নতুন সমস্যার শুরু হয়। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিকে ধর্মীয় বিধানানুযায়ী অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করতে হবে। এদিকে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়।
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে যে, আত্মহত্যা-সংকটের সমাধান নয়। বরং নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। একথা স্বীকার্য যে, মৃত্যু মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। মৃত্যুই একমাত্র ‘নিশ্চিত’ থাকে। কিন্তু আত্মহত্যার মতো অনাকাংখিত মৃত্যু কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আত্মহত্যার হার যেন শূন্যের কোটায় চলে আসে।

লেখক : কলামিস্ট, সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনার নতুন মেরুকরণ : ভয়ংকর গতিপথ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল