আত্মত্যাগের বিস্মৃত কাহিনি

মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা

মহুয়া ভট্টাচার্য | শনিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির বীরত্ব খচিত অধ্যায় ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের অর্জন। জাতির এই গৌরবের ইতিহাস কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি। শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পেতে একটি স্বাধীন দেশে সকল মতাদর্শের মানুষ মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারবে, এমনই ছিলো এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সুখস্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর এদেশেরই কিছু বেঈমান ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিলো এদেশকে মেধাশূন্য করা এবং অপর উদ্দেশ্যটি ছিলো- হিন্দু নিধন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি হিন্দু জনগোষ্ঠীও রোষের বিষয় ছিলো। তাদের ধারণা ছিল, হিন্দু সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ইসলামিক সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবাষ্প অন্তরে নিয়ে হিন্দু নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে নির্বিচারে। হত্যা করেছে খৎনা না করা, কলেমা পড়তে না জানা হিন্দু পুরুষদের। ক্যাম্পে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে নারীদের, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে কেটে পাশবিক নির্যাতনের নজির রেখে গেছে তারা। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল সময়ের কথা তথ্য উপাত্ত নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর, এখনো হচ্ছে কিন্তু সমস্ত বিষয়টিই শুধুমাত্র গণহত্যার স্রোতে মিশে যাচ্ছে। অথচ বিশাল সংখ্যার একটি জনগোষ্ঠী শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণেই আমাদের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মাহুতি দিতে হলো, সেই হত্যা কেবল গণহত্যা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক জরিপে দেখা গেছে ভারতের শরণার্থী শিবিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিলো হিন্দু। শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু সংখ্যা ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ৬ লাখ। বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রটির জন্মের পেছনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যে করুণ দুর্দশার কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় সঠিক মূল্যায়িত হয়নি। আর ঠিক এই কারণেই এক নদী রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আজকের এই স্বাধীন মানচিত্রে হিন্দু ধর্মবলম্বীরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও রয়ে গেছে সংখ্যালঘু হিসেবে। প্রসঙ্গতই এই বিস্মৃত আত্মত্যাগের কাহিনি আজ তুলে ধরবো কেবল দক্ষিণ চট্টগ্রামেরই বোয়ালখালী উপজেলার ৭১ এর গণহত্যা তথা হিন্দু নিধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
কধুরখীল ইউনিয়নের গণহত্যা : কধুরখীল ইউনিয়নে গণহত্যা তথা হিন্দু নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয় ৩১শে অক্টোবর ১৯৭১। সেদিন পাকবাহিনী ও রাজাকারেরা যেসকল নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছিলো তার অধিকাংশ ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশ : মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৫, ডিসেম্বর ২০২০ (প্রধান সম্পাদক : হারুন- অর-রশিদ। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি) এর বর্ণনায় পাওয়া যায়- ঘটনার দিন ভোরে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা কধুরখীলের নাপিতঘাটা ও দক্ষিণপাড়ায় রাজাকারদের ওপর অপারেশন চালিয়ে ৮ জন রাজাকারকে হত্যা ও ৫ জনকে বন্দী করেন।এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও অনেক রাজাকার সেদিন বিকেল ৪টার দিকে কধুরখীল গ্রামে ভয়াবহ আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য নিরীহ লোকজন কর্তফুলী নদী পেরিয়ে রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার দিকে পালাতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের উত্তর পাড়া ও দক্ষিণ পাড়ায় অনেকক্ষণ তাণ্ডব চালিয়ে অনেক নারীকে ধর্ষণ করে এবং অনেককে বন্দী করে। কধুরখীল দুর্গাবাড়ি সংলগ্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার ২১ জনকে ব্রাশ ফায়ার করা হয় একই সাথে, যাদের মধ্যে একজন বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে। তাঁর নাম অমূল্যরঞ্জন বর্ধন। কধুর এলাকার সেই সময়কার বহু প্রতক্ষ্যদর্শীর স্মৃতিতে জাগ্রত সেই ভয়াল সময়ের কথা। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যার পর লাশের স্তূপ ফেলে রেখে চলে যায়। গলিত পচা সেই লাশের সৎকার মেলেনি, একই সাথে ঠাঁই হয় গণকবরে।
শাকপুরা এলাকায় গণহত্যা : মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দানকারী শহীদ সন্তান বাবুল চক্রবর্তী বুলবুল তাঁর যে বয়ান দিয়েছিলেন, তা বস্তুত ছিলো হিন্দু নিধনযজ্ঞ। বাবুল চক্রবর্তী শহীদ মনমোহন চক্রবর্তীর সন্তান। তাঁর বর্ণনায় প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ শহীদের বর্ণনা পাওয়া যায়, যার সিংহভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু শাকপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তার পাশের স্মৃতিস্তম্ভে কেবল ৭৬ জন শহীদের নাম রয়েছে, বাকিরা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।
স্থানীয় দালালরা ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আছে এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে হানাদারদের সাথে নিয়ে পশ্চিম শাকপুরার প্রশিক্ষণ স্থান দারোগামাঠ সংলগ্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ঘিরে শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ছনখোলা, বাগিচা ও ঝাড়-জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণকারী ও দিগ্‌বিদিক পলায়নরত এলাকাবাসী এবং শহর থেকে এসে আশ্রয় নেয়া স্বর্ণকার, ব্যবসায়ী ও ১৬ এপ্রিলে রসহরি মহাজনদের বাড়ি, পার্শ্ববর্তি এলাকা ও মিলিটারী পুলে আহত মধ্যম শাকপুরাবাসীসহ দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে।
চার ঘন্টারও অধিক সময়ব্যাপী অগ্নিসংযোগ ও এলোপাথারি গুলিবর্ষণে হত্যাকাণ্ডকালীন অসহায় মা-বোনদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। মৃত্যুপুরী শাকপুরার জনপদের রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে, ছনখোলা, বাগিচা ও ঝোপে-ঝাড়ে পড়ে থাকা পচা-গলা লাশগুলো পরিবেশ দূষিত করে। দু’এক দিনের মধ্যে ফিরে আসা ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলো এলাকার বিভিন্নস্থানে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে থাকা গলিত লাশগুলোকে এক জায়গায় এনে কোনমতে মাটি চাপা দিয়ে গণকবর দেয়।
এভাবে পশ্চিম শাকপুরা গ্রামের দারোগামাঠ ট্রেনিংক্যাম্প সংলগ্ন চতুর্পার্শ্বস্থ এলাকা এক বিশাল বধ্যভূমিতে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে হানাদার বাহিনীয় সহযোগী স্থানীয় দালাল, তথাকথিত শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা সংঘবদ্ধভাবে অনবরত সম্পূর্ণ এলাকা ঘেরাও করে আরো দু’বার গণহত্যা চালায়। শাকপুরা এলাকারই আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী মিনা আচার্যের বয়ানে আমরা পাই, হিন্দু নারীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার, সম্ভ্রমহানি ও আতংকে কাঁটা ভয়াল দিনগুলোর কথা। একই বর্ণনা চিত্র পেয়েছি আমার নিজ গ্রাম সারোয়াতলী এলাকার, যা আমার পিতামহীর মুখে শোনা। তাঁরা যখন প্রাণভয়ে ঝোঁপে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন উঠতি বয়সী মেয়ে আর যুবতী বউদের নিয়ে, সেসময় পাশের মুসলমান পাড়ার বেশিরভাগই উদ্বেগহীন। বহু হিন্দু নারী নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচাতে মুসলিম পাড়াগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমন নজিরও দেখা যায়। কিন্তু সেই আত্মত্যাগ ও কষ্টের দিনগুলো বেশিরভাগ হিন্দুরাই মনে রাখতে চান না আজ! বলার চেষ্টা থাকে, এই অঞ্চলের মানুষের অসামপ্রদায়িক, সকল ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থান। কিন্তু এই নীতিবাক্যের আড়ালেও আছে রাজনীতি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান নড়বড়ে হচ্ছে চূড়ান্তভাবে। যখন নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের সর্বোচ্চ আশ্রয়স্থল থেকেও স্ব স্ব ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথা শুনতে হয়, সেই দেশের স্বাধীনতায়, সংগ্রামে, ত্যাগে অন্য ধর্মের মানুষেরও কিছু অবদান ছিলো। তাদের করুণ কাহিনিও এখন স্বতন্ত্র স্বীকৃতির দাবিদার। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা হয়েছে বহু, এখনো হচ্ছে। তবে এই ইতিহাসে এই হিন্দু জেনোসাইডটি সঠিকভাবে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপনের দাবি রেখে গেলাম সুধী সমাজের কাছে। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর আক্রমণ কেবল বাঙালি নিধন ছিলো না, এটি সচেতনভাবেই হিন্দু নিধনযজ্ঞও ছিলো।
তথ্যসূত্র : গবেষক শামসুল আরেফিন
লেখক : গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসম বন্টনের সাম্যতায় মনুষ্যত্ব
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালে শেষ যাত্রার সঙ্গী