অসম বন্টনের সাম্যতায় মনুষ্যত্ব

চন্দ্রিমা আলো | শনিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

শুরু থেকেই একে অপরের সহযোগী কিংবা পরিপূরক হিসেবে সৃষ্ট। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েও কেউ পথপ্রদর্শক এবং কেউ অনুগামী। তবে বিপথগামীতেও সমতা বিধান হয়েছে। কিন্তু সুষম বন্টন যদি সর্বত্রই বিরাজমান হবে তাহলে বিজিতের আনন্দ কেনোই বা রবে! সবাই যদি রাজা হয় কিংবা প্রজা হয় তাহলে শাসন কিংবা শোষণ সবই অপ্রয়োজনীয়। সাতটি দোজখ কিংবা আটটি বেহেশতের কেনই বা প্রয়োজন! সেখানেও সমতা প্রয়োজন ছিল। বিষয়টি মূলত তা নয়। সমাজে ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক, ব্যবসায়ী প্রত্যেক পেশার মানুষের প্রয়োজন প্রত্যেকের বাঁচার জন্য, সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য। তা না হলে একজন ডাক্তারকে কখনও চাষা, কখনও মুচি, কখনও দর্জি, কখনও গৃহিনী, কখনও শিক্ষক, কখনও ড্রাইভার, কখনও ঝাড়ুদার ইত্যাদি হতে হবে। অর্থাৎ তার কোনো কাজের জন্য নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। কিন্তু এটা যদি হয় দিবা স্বপ্ন, তাহলেই সম্ভব; অন্যথায় নয়। আর তাই তো যুগে যুগে শ্রেণি বৈষম্য, সম্পদের অসম বন্টন।
আর যদি অন্যভাবে বলি বিজয়ের আনন্দ, সৃষ্টির অদম্য স্পৃহা, নতুনত্ব। কার্ল মাক্সের উদ্বৃত্ত মূল্য খুবই গুরুত্বের দাবিদার। কিন্তু শ্রেণিহীন সমাজ কি আদৌ সম্ভব? এই অসম বন্টনের মাঝে যার যা অপূর্ণতা তা মেনে নিয়ে অনুগামী কিংবা অগ্রগামীকে হৃদয়ে ধরে সুশীল সমাজ কিংবা পরিবার গঠন করা যায়; এবং তার জন্য প্রয়োজন শ্রদ্ধা, বিনয়, কিছুটা ত্যাগ স্বীকার, মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া, সমযোতা। তারপরও অপূর্ণতা থাকবে; কারণ তা না হলে সৃষ্টিই হতো না। মানুষ অপূর্ণ সত্তা, পূর্ণ তো ঈশ্বর। আর তা মেনে নিতে পারি না, প্রাপ্তির লাগামহীনতা ছুটছি বিধায় আজ আমরা হতাশাগ্রস্ত। অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি সবকিছুর পরও একাকিত্ব আমাদের সঙ্গী; নিদারুণ একটা অতৃপ্তি নিয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হই।
জ্ঞানী ব্যক্তি নাকি বিনয়ী হয়। তাহলে একজন ডাক্তার, সচিব, মন্ত্রী কিংবা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের কেনো এত অহংকার? কেনো এতটা বিনয়ের অভাব? কেনো ক্ষমতার দাপট? আইন তো সবার জন্য সমান। মানুষ তো শ্রেষ্ঠ জীব; তবে মনুষ্যত্বে কেনো এত হীনম্মন্যতা? কেনো আত্ম-স্বার্থসিদ্ধির লড়াই? আমাদের তাদের প্রতি আরও কৃতজ্ঞ, আরও শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত; যারা আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা বাঁচার উপকরণ যুগিয়েছে। হ্যাঁ, আমি গর্ব করে বলতে পারি আমি একজন খেটে খাওয়া মানুষ; আমি সাধারণ বিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রী কিংবা আত্ম-অহংকারী বানানো বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলে অধ্যয়নের সুযোগ না পাওয়া ছাত্রী; আমি একজন চাষা কিংবা শ্রমিক কিংবা তপ্তরোদে পুড়ে ফেরি করা বাবার সন্তান। আমি লজ্জিত হতাম যদি সুদ, ঘুষ, দেশের সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদে বিলাসিতা কিংবা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া কিংবা চোর, সন্ত্রাস কিংবা অসৎ, প্রতারক কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ওরশজাত সন্তান হতাম। প্রাপ্তির খাতা অসম্পূর্ণ থাক কিন্তু তৃপ্তিটুকু যেনো শুধু আমার-ই হয়। অন্য কারও পরিচয়ে, ক্ষমতায় আমি ধন্য হতে চাই না, আমার পরিচয় আমি নিজেই; আমি মানুষ। অসম বন্টন নিয়ে আমি হতাশ কিংবা লজ্জিত নই; আমি লজ্জিত কিংবা হতাশ অসম বন্টনের আত্ম-অহংকারে, ক্ষমতার দাপটে, বিবেকের মৃত্যুতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসাধারণ এক বাবার কথা
পরবর্তী নিবন্ধআত্মত্যাগের বিস্মৃত কাহিনি