জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৩৬ খালের মধ্যে সাতটির কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট খালগুলোর মধ্যে ১১টির কাজ চলতি মৌসুমে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে প্রকল্প বস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে আগামী বর্ষার আগে ১৮ খালের কাজ সম্পন্ন হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজ আটকে আছে বাকি ১৮ খালের।
কাজ আটকে থাকা খালগুলোর মধ্যে শহরের পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ চাক্তাই খালও রয়েছে। কাজ আটকে থাকা খালগুলোর দুই পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় ২৯টি সিল্ট ট্রাপ নির্মাণ করা যাচ্ছে না। আটকে আছে তিনটি জলাধার নির্মাণ এবং খালের পাশে সড়ক নির্মাণ কাজও। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) গৃহীত এ মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে ছয় হাজার ৫১৬ কাঠা ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে এ অধিগ্রহণ শুরুই হয়নি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনী কিছু কিছু অংশে ভূমি মালিকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শেষ করে। এক্ষেত্রে ভূমির মালিকদের আশ্বাস দিয়েছে, জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ শুরু করলে
উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রকল্পে এক হাজার ৭২৭ কোটি ৮৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর বাইরে স্থাপনার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরো ১৭ কোটি এক লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। এরপরও ভূমি অধিগ্রহণের এ দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে জানা গেছে, ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা ভূমি মূল্যের দেড় গুণ হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে সরকার ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জমির ক্ষতিপূরণ তিন গুণ বৃদ্ধি করে। ফলে অতিরিক্ত অর্থ সংস্থান না হওয়ায় অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না। অবশ্য সংশোধিত ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়। তবে সংশোধিত প্রকল্প এখনো অনুমোদন হয়নি।
সংশোধিত প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাবনার বিষয়টি নিশ্চিত করে উপ-প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী কাদের নেওয়াজ আজাদীকে বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছে আমরা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। কিন্তু এখানো তাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা লাগবে তার ডিমান্ড নোট পাইনি। ডিমান্ড পেলে টাকা দিয়ে দেব। সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন হয়ে যাবে। তাই টাকার সমস্যা হবে না। কিছু কিছু অংশে নিজেরাই অধিগ্রহণ করে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদীকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে আছে। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি দেখবে সিডিএ। তাদের আমরা জানিয়েছি। তিনি বলেন, আগামী বর্ষার আগে ১৮টি খালের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আশা করছি এবার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী।
ভূমি অধিগ্রহণে আটকে থাকা কাজ : ভূমি অধিগ্রহণের জন্য কাজ আটকে থাকা খালগুলো হচ্ছে চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, মহেশখাল, চশমা খাল, রাজাখালী খাল-১ ও ৩, বির্জা খাল, হিজরা খাল, জামালখান খাল, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, নোয়া খাল, ডোমখালী খাল, বামনশাহী খাল, শীতলঝর্ণা খাল, নয়ারহাট খাল, গয়নাছড়া খাল, মহেশখালী খাল ও খন্দকিয়া খাল।
ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের দুই পাড়ে ১৭৬ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে ৮০ কিলোমিটার নির্মাণ শেষ হয়েছে। আরো ১২ কিলোমিটারে চলমান আছে। তবে ৭০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে হিজরা খালের দুই দশমিক সাত কিলোমিটার অংশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত আছে। অথচ মাত্র সাড়ে ৫০০ মিটার অংশে নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ না করায় বাকি অংশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। একইভাবে ত্রিপুরা খালের আমিন জুট মিল এলাকায় সাড়ে ৩০০ মিটার অংশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এছাড়া মির্জা খালের মোহাম্মদপুর পর্যন্ত খালের দুই পাশে দুই দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশেও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ আটকে আছে।
চাক্তাই খালের এক পাশে রিটেইনিং ওয়াল করা গেলেও অপর পাশের সিংহভাগ অংশ বাকি আছে। এর মধ্যে বহদ্দারহাট থেকে ফুলতলা পর্যন্ত বাম পাশে কাজ শেষ হলেও ডান পাশে ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়া করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে কাজ শেষ হওয়া খালগুলো হচ্ছে কলাবাগিচা খাল, মরিয়ম বিবি খাল, রাজাখালী খাল-২, সদরঘাট খাল-১, সদরঘাট খাল-২, গুপ্ত খাল ও আজব বাহার খাল। চলতি মৌসুমে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা খালগুলো হচ্ছে রাজাখালী খাল-৩, মোগলটুলি খাল, টেকপাড়া খাল, রুবি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি খাল, ত্রিপুরা খাল, উত্তরা খাল, নাসির খাল, বাকলিয়া খাল, ফিরিঙ্গিবাজার খাল, বদরখালী খাল ও বাকলিয়া খাল।
ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় খালের পাড়ে ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ৫ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। চলমান আছে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। যেখানে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে না। বাকি রাস্তা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
ডিপিপি অনুযায়ী, পাহাড়ের পলিমাটি ও বালি ধারণের জন্য ৪২টি সিল্ট ট্রাপ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ১৩টির কাজ প্রায় শেষ। বাকি ২৯টি সিল্ট ট্রাপ নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
ডিপিপি অনুযায়ী, পানি ধারণের জন্য তিনটি স্টর্ম ওয়াটার রিজার্ভার বা জলাধার নির্মাণ করা হবে। যেগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণে কাজ আসবে। প্রাথমিকভাবে হালিশহর, চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকায় জলাধারগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সেনাবাহিনী। তবে ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় একটিরও নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি।
প্রসঙ্গত, ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পটি পাঁচ হাজার ৬শ ১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। পরবর্তীতে নানা প্রক্রিয়া শেষে একই বছরের ২৮ এপ্রিল নগরীর চশমা খাল ছাড়াও মুরাদপুর এলাকার সুন্নিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন খাল ও বহদ্দারহাট মোড়ের বড় নালা পরিষ্কার করার মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল।