আজ বিশ্ব এ্যানেসথেসিয়া দিবস

ডাঃ দুলাল দাশ | শনিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব এ্যানেসথেসিয়া দিবসটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত প্রতি বৎসর বাংলাদেশেও পালিত হয়। মেডিক্যাল সাইন্সে এ্যানেসথেসিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। যে কোন সার্জারী বা অপারেশন এ্যানেসথেসিয়া ছাড়া করা যায় না বা করা উচিত নয়। তাই ইহার গুরুত্ব অসীম। বাংলাদেশ তথা বিশ্বে খুবই কম সংখ্যক লোক এ্যানেসথেসিয়া সম্বন্ধে জানে। তবে প্রত্যেকের এই বিষয়টা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকা উচিত।
প্রথমেই বলতে চাই এ্যানেসথেসিয়া কী? এটার বাংলা অর্থ “চেতনানাশক বা অসাড়তা”। ইংরেজিতে বলতে গেলে Anaesthesia means absence of Sensation artificially induced anaesthetic agents or the injection of drugs. সাধারণত Anaesthesia কে দুইভাগে ভাগ করা হয় (১) জেনারেল এ্যানেসথেসিয়া অর্থাৎ পুরো শরীরটাকে বেদনামুক্ত অচেতন করে দেওয়া (২) লোকেল এ্যানেসথেসিয়া অর্থাৎ শরীরের একটা নির্দিষ্ট অংশ বা জায়গাকে বেদনামুক্ত রাখা। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখতে পাই ২০০০ B.C যখন Herbs এবং wine ব্যবহার করে প্লাষ্টিক সার্জারী করা হত। তেমন দেখতে পাই Buddhist writing 500 B.C রোগীকে দাঁড়ানো অবস্থায় পিলারের সাথে টাইট করে বেঁধে পেটের অপারেশন ও চিৎ করে ফেলে মাথার খুলির অপারেশন করা হত। ঐবৎন এবং ডরহব ব্যবহার করত ব্যথা নিরাময়ের জন্য। কী নির্মম! আজকাল এটা চিন্তা করাও যায়না। তারপর ১৮৪৬ সালে এ্যানেসথেসিয়ার সূচনা হয়। ১৯২০ সালে শুরু হয় ক্লোরোফর্ম এবং ইথারের ব্যবহার। বেশ কয়েক বৎসর আগেও ইহার ব্যবহার দেখেছি। তারপর ধাপে ধাপে অতি দ্রুত এ্যানেসথেসিয়ার পদ্ধতির উন্নতি হল। Machine আবিষ্কার হল। আধুনিক যন্ত্রপাতি চলে আসল। Anaesthetic Agents ওষুধ আবিষ্কার হল এবং গ্যাসের ব্যবহার শুরু হল। বড় বড় অপারেশনের সময় মাংসপেশীকে শিথিল (Relaxed) রাখার জন্য যে ওষুধ Anesthesiologist’রা ব্যবহার করে সেটা বহু বৎসর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন এলাকার লোকেরা এক প্রকার গাছের পাতা ও ছাল তীর ধনুকের মাথায় বেঁধে পশু পাখি শিকার করত। ঐ পাতা ও ছালের রস পশুর শরীরে প্রবেশ করলে তারা নিস্তেজ হয়ে যেত। এই সাবজেক্টের আরও প্রকারভেদ আছে। যেমন Regional Anaesthesia একটা এরিয়াকে অবশ করা, Spinal এবং Epidural Anaesthesia; Full range Nerveblock; Surface Anaesthesia প্রভৃতি। এ্যানেসথেসিয়ায় রোগীদের মধ্যে একটা ভয়-ভীতি থাকে। রোগীর নিকটজন ভয়ে থাকে বেহুঁশ হওয়ার পর হুঁশ হবে কিনা? মৃত্যুকে কেনা ভয় পায়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ বাঁচতে চায়। রোগী অপারেশন টেবিলে উঠার আগে একজন অজ্ঞানকারী ডাক্তার তার শারীরিক অবস্থা দেখবে, সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখবে রোগী এ্যানেসথেসিয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা। এটাকে Pre-anaesthetic check-up বলা হয়। আজকাল সবার মুখে মুখে পেট না কেটে মেশিনের সাহায্যে (Laparoscopy Machine) পেট ফুটো করে Gall Bladder (পিত্তথলি) Appendix প্রভৃতি অপারেশনের কথা। বর্তমান পেট ফুটো করে অনেক ধরনের অপারেশন হয়। যেমন- কিডনীর পাথর ও অন্যান্য। এ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগ মুহূর্তে রোগীকে আশ্বস্থ করতে হয় যাতে ভয় না পায়। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার পর ঘুম আসার সাথে সাথে শ্বাস নালীতে একটা টিউব প্রবেশ করানো হয় (Endotracheal Tube) এবং ঐ টিউবের সাহায্যে এ্যানেসথেসিয়া মেশিনের সংযোগ স্থাপন করা হয় এবং Breathing Bag এর সাহায্যে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসকে সচল রেখে পুরো এ্যানেসথেসিয়া প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয়। পর্যায়ক্রমে ওষুধের মাধ্যমে এ্যানেসথেসিয়া কার্যপ্রণালী দীর্ঘায়িত করা হয়। অপারেশন শেষ হওয়ার পর Antidote injection এর মাধ্যমে রোগীকে জাগিয়ে তোলা হয়। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে রোগী চোখ খুলে, জিহ্বা দেখায়। একটু পরে বেদনানাশক injection দেওয়া হয়। বর্তমান অতি জনপ্রিয় ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ Spinal ও Epidural Anaesthesia ব্যবহার হচ্ছে। নাভির নীচে ৯০% অপারেশন এই পদ্ধতিতে হয়। এই পদ্ধতিতে সিজারিয়ান অপারেশনে বাচ্চা বাহির করার সাথে সাথে মা বাচ্চার কান্না শুনতে পায়, মুখে চুমু দিতে পারে। এক বা দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হয় মাত্র। বর্তমান বিশ্বে Medical Science এর অভূতপূর্ব উন্নতি ও সাফল্যের সাথে সাথে এ্যানেসথেসিয়া বিষয়েরও অনেক উন্নীত হয়েছে। এখন Anesthesia ৯৯% ঝুঁকিমুক্ত। কারণ এখন অপারেশনের সময় মনিটরিং সিস্টেম খুবই সক্রিয়। যেটা আমাদের দেশে এক সময় ছিল না। এ বিষয়ের উন্নতির ফলে শৈল্য চিকিৎসকরা অসাধ্য সাধন করছে। সার্জারী ফিল্ডে অনায়াসে বিচরণ করতে পারছে। একই রোগীর উপর একনাগাড়ে ৪৮ ঘন্টার উপর অপারেশন কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। সেটার নজিরও আছে। কয়েক বছর আগে সিংগাপুরে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে দুই মাথা লাগানো ইরানী জমজ দুই বোনের শরীরে ৪৮ ঘন্টা অপারেশন করে জোড়া মাথা সাফল্যের সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আধুনিক এ্যানেসথেসিয়ার বদৌলতে ইহা সম্ভব হয়েছে। কারোনা কালে I.C.U সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। যেকোন সঙ্কটাপন্ন রোগীকে I.C.U তে ভর্তি করে জীবন বাঁচানোর সব চেষ্টা করা হয়। যেখানে ভেন্টিলেটরের সাহায্যে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। I.C.U ওয়ার্ডের মুখ্য ভূমিকায় থাকে একজন এ্যানেসথেসিওলজিষ্ট।
বাংলাদেশে এ্যানেসথেসিওলজি বিভাগ আগের থেকে অনেক উন্নত ও অনেকটা বিশ্বমানের। বড় বড় সরকারি ও বেসরকারী হাসপাতালে Anaesthesiologist এর সংখ্যা আগের তুলনায় ভাল, তবে অভাব রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সারাদেশে Anaesthesiologist এর ভীষণ অভাব দেখা যায়। যার ফলে ঐ সমস্ত হাসপাতালে মেজর কোন অপারেশন হয় না কিছু হাসপাতাল ছাড়া। তাই সরকার এই ব্যাপারে আরও সদয় দৃষ্টি দিবেন।
লেখক : চিফ এ্যানেসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালি জাতির অলংকার