আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন

সোহেল চৌধুরী হত্যা

| শুক্রবার , ১০ মে, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ঢাকাই সিনেমার নব্বই দশকের নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যার ঘটনায় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজসহ তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গ তাদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দ্বিতীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী গতকাল বৃহস্পতিবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়া দণ্ডিত অপর দুজন হলেন, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম এবং আদনান সিদ্দিকী। তারা তিনজনই পলাতক।

মামলার বাকি ছয় আসামিকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। তারা হলেনসেলিম খান, দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন ও ফারুক আব্বাসী। খবর বিডিনিউজের।

রায়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, সোহেল চৌধুরী কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষের বেশিরভাগ সাক্ষী গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে অনেকে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। বান্টি ইসলাম বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক, সেটির কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে। আর আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ধাক্কাধাক্কিধস্তাধস্তি হয়এর আগের একটি বিষয় নিয়ে। বলা হয়েছে, এটি মিটমাট হয়ে গেছে, কিন্তু আসলে মিটমাট হয়নি। আজিজ মোহাম্মদের সঙ্গে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর পূর্ব শত্রুতা ছিল। বান্টি ঘটনাস্থলে ছিলেন, এটা প্রমাণিত। এ মামলার বিচার শেষ হতে ২৬ বছর লেগে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বিচারক বলেন, প্রতিটি আত্মা হত্যার বিচার চায়। এত পুরানো মামলা এতদিন ধরে চলতে পারে না।

কী ঘটেছিল : ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার দিনই তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। মামলায় বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর কথাকাটাকাটি হয়। এর প্রতিশোধ নিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয়।

ঘটনার বর্ণনায় এজাহারে বলা হয়, সেই রাতে সোহেল তার বন্ধুদের নিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। রাত আড়াইটার দিকে আবারও তিনি ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সোহেলকে লক্ষ্য করে ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক ও আদনান গুলি চালান। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

এরপর ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৩ সালে ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। কিন্তু আসামিদের মধ্যে তারিক সাঈদ মামুনের পক্ষে ২০০৪ সালে হাই কোর্টে মামলাটি বাতিল চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত একটি রুল দেয়, সেই সঙ্গে বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ আসে। এরপর দীর্ঘদিন মামলাটির নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সবার নজরে আসে। ২০১৫ সালের ৫ অগাস্ট হাই কোর্ট সেই রুল খারিজ করে রায় দিলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তারপর বিচারিক আদালতে পুনরায় বিচার শুরু হয়।

মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে মাত্র ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়। আসামিদের মধ্যে সানজিদুল হাসান ইমন এবং আশিষ রায় চৌধুরী গত ১১ ফেব্রুয়ারি আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে লিখিত বক্তব্য দেন। তারা দুজনেই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে নামের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেছিলেন সোহেল চৌধুরী। একই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন পারভিন সুলতানা দিতিও। পরে দুই তারকা বিয়ে করেন, দুটি সন্তানও রয়েছে তাদের।

রায়ের প্রতিক্রিয়া : দণ্ডিত পলাতক আসামি আদনান সিদ্দিকীর পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মোসলেহ উদ্দিন জসীম রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আদনান সিদ্দিকী এ মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও জবানবন্দি গ্রহণকারী তৎকালীর হাকিম মাকসুদুর রহমান পাটোয়ারী আদালতে হাজির হয়ে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেননি। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদর্শনী আকারে নথিতে যায়নি। সুতরাং তার বিরুদ্ধে এ রায় হতে পারে না।

পলাতক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ইমামুল হুসাইন ফিরোজ বলেন, এরকম রায় হতে পারে না। বিচারের সময় কোন সাক্ষীই বলেনি কার গুলিতে সোহেল চৌধুরী নিহত হয়েছেন। আমার মোয়াক্কেল আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি উচ্চ আদালতে আপিল করব। পলাতক বান্টি ইসলামের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী কাজী আবদুল মতিন বলেন, এ মামলা অন্য একজন আইনজীবী পরিচালনা করতেন। পরে আমি বান্টি ইসলামের পক্ষে দাঁড়াই। রায়ে আমি অসন্তুষ্ট। বান্টি যদি যোগাযোগ করেন, তবে উ্‌চ্চ আদালতে যাব।

খালাস পাওয়া সানজিদুল হাসান ইমনের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ মামলার চার তদন্ত কর্মকর্তার সবাই মারা যাওয়ায় একজনও আদালতে এসে বিচারের সময় সাক্ষ্য দিতে পারেননি। যদিও মামলার সাক্ষীদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ছিল। এ মামলার পরিণতি কী হবে সবাই জানত। এ মামলায় আমার মোয়াক্কেলকে সাজা দেওয়ার কোনো গ্রাউন্ড বিচারক পাননি। রায়ের জন্য সানজিদুল হাসান ইমনকে এদিন কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। অন্য কোনো মামলায় আটক রাখার প্রয়োজন না থাকলে তাকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। জামিনে থাকা আশীষ চৌধুরীও আদালতে হাজির ছিলেন। তাকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দেওয়া হয়। খালাস পাওয়া অন্য ৪ জন পলাতক, তাদের বিরুদ্ধে আগে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাকিতে মাছ কিনে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ
পরবর্তী নিবন্ধখোলাবাজারে ডলার সংকট, পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকায়