আজাদের বামপন্থি ‘শূন্য’

মোহাম্মদ আলী | বৃহস্পতিবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

‘আমি মনে করি আমি যে সময়টাতে লিখতে আসছি সেটা সাহিত্যের পোস্ট মডার্নিজমের কাল, ফলে এখনকার সাহিত্যও নতুন ঘরানার’-কবি মীর রবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আজাদের এই স্বীকারোক্তি থেকেই তার কবিতার স্বর আন্দাজ করা যায়। একরাম আজাদ মূলত অস্থির ইলেকট্রনিক যুগের কবি। ফ্রয়েডীয় চেতনার গুণে বেশি সিদ্ধ হলেও উত্তরাধুনিক ব্যক্তিমানুষ ও সমকালচেতনা তার কবিতায় অভিনব কায়দায় সমাজ, সংস্কার ও প্রচলিত বিশ্বাসকে স্ট্যাম্পিং করে। বাঁ পাশের শূন্য নিয়ে কবি অনিয়মের জোটবদ্ধ সমাজের বিপরীত স্রোতে হাঁটতে পছন্দ করেন। প্রথাগত সমাজ-সংসারের অনেক কিছুকে নিজের সাথে খাপে মেলাতে পারেন না; তাই তো বাঁ পাশের শূন্য হয়ে বাঁ পাশের জীবনকে গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন এই তরুণ প্রজন্মের সমঝদার কবি। চারপাশের সকলেই যখন অনুকূলের অনুকরণে মশগুল তখন বিপরীতমুখী স্লোগানের এক বার্তা প্রেরণ করলেন কবি ‘বিপরীত স্লোগান’ কবিতায় : ‘পিনপতন এই নীরবতা আমি ভাংব সুবোধ-ভাংবই।’ ফ্যাসিবাদের কালে সময় পক্ষে নয় বলে সবাই যখন সুবোধকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়ে শহরের দেওয়ালগুলো গ্রাফিতিতে ভরিয়ে তুলছে, তখন তাকে আস্বস্ত করে কবি পরামর্শ দিচ্ছেন বিপ্লবের : ‘…অসময় বলে কি প্রেম ফেলে পালাতে পারে কোনো প্রেমিক?/ এই ভূমি যে আত্মার প্রেয়সী তোমার, পূর্বজের ফসিল।/ ঘৃণা নয়, বিতৃষ্ণা নয়, বিপ্লব চাই-বিপ্লব!’ বাঙালির আছে চিরায়ত কৃষিভিত্তিক এক সংগ্রামী জীবনচিত্র। সেই পূর্বপুরুষের স্থবির কাস্তে আবার শান দিয়ে বিলুপ্ত সংগ্রামী জীবনকে নতুন জাগরণের মন্ত্র শোনাতে চান। সমাজতান্ত্রিক একটি মুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা কবির লিকলিকে বুকের পাঁজরে। তাই তো চারপাশের মমি হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আরেকবার নাড়া দিয়ে খাঁড়া করে সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের পৃথিবীতে নিজের মৌলিক জৈবনিক অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে চান।
আজাদ মূলত গদ্য ছন্দে কবিতা লিখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার স্বপক্ষে একটা ব্যাখ্যাও আছে-গদ্যের ক্লাসের ছাত্র যখন পদ্যের ক্লাসে ঝাঁপ দেবেন তার কিছু ধাপের ঝাঁঝ তো থাকবেই; অথবা এটাই কবির সহজাত স্বভাব। ফলে বাঁ পাশের শূন্য কাব্যগ্রন্থে খেয়াল করলেই দেখা যাবে আটত্রিশটি কবিতা গদ্য-পদ্যের যূথবদ্ধ অভিসার। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো অধিকাংশই আত্মকথনের ছাঁচে তৈরি। গদ্য ধাঁচে কবিতার সুচারু সরল বিবৃতিতে কবি নিজেকে তুলে ধরছেন পাঠকের সামনে। তবে এক্ষেত্রে সরল বিষয় হলো, পৈতৃক বিশ্বাসের সাথে টেনে আনছেন প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি চরম অনাস্থা এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ভুল রাজনীতির খেসারত। ‘পতাকা’ কবিতায় আমরা দেখি ঘরের চালায় সকাল-সন্ধ্যা পত পত করে একটি পতাকা নেচে যাচ্ছে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই পতাকা টাঙানোর মতো বিশেষ কোনো আল্লাদ আর দশজন বিত্তহীন বাসিন্দার মতো কবিরও ছিল না। কেননা উপমহাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক পালাবদল এবং পতাকা ও সীমানাপ্রাচীর পরিবর্তিত হলেও মানুষের ভাগ্য পূর্বাবস্থানে আটকে আছে। তাই লাল সবুজের বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও দূরদর্শী কবির চিত্তে বারবারই দ্বিধার জন্ম দিয়েছে ’৪৭ ও ’৭১-এর ভূখণ্ড ভাগের সুফল-কুফল। অথচ যে পতাকা পেলে আমাদের সমস্ত দুঃখ বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা ছিল, যাবতীয় অশুভ মুছে শুভবুদ্ধির নিশানা উড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই স্বপ্নভূমিতে বিষণ্ন সন্ধ্যায় কবি দেখছেন লাশগাড়িতে বোনের লাশ। আজাদ তার সরল বিবৃতির কবিতায় নিজের বিগত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন বলে পাঠক প্রাথমিকভাবে ভেবে নিতে পারে; কিন্তু মনযোগী পাঠক একটু এগোলেই দেখবে সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার সচিত্র প্রতিবেদন। পাঠকের চোখের সামনে কবি বিবৃত করেছেন এভাবে : ‘এক সন্ধ্যায় আমাদের উঠোনেও একটি লাশগাড়ি দেখা যায়-আমার বোনকে দিতে এসেছে। শি হেজ বিন রেপড বাই আ গ্যাং আন্ডার সানশাইন। সব ছাড়িয়ে হঠাৎ আমার চোখ চলে যায় কোনার সেই পতাকার দিকে। আমার বোনের মতো খামচে যাওয়া পতাকাটি তখনও পত পত করে নেচে যাচ্ছে!’ আমরা যদি ‘আমার উঠোনেও’ শব্দযুগলের দিকে খেয়াল করি, ‘উঠোনে’-এর শেষে ‘ও’ যুক্ত হয়ে তাকে ব্যক্তিগত উঠান থেকে সর্বজনীন রূপ দিচ্ছে। আবার লাশগাড়ি থেকে দৃষ্টি তুলে সোজা পতাকার উপর কবির চোখ ফেলা এবং পত পত করে তখনও নির্বিকার নেচে যাওয়ার ভঙ্গি আমাদের চেতনায় স্বপ্নভঙ্গের আবহ সৃষ্টি করে। এখানেই ব্যক্তি কবি একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে ওঠেন।
একরাম আজাদের কবিতার একটি সহজ বিষয় হলো পাঠক কবিতার পাঠ শুরু করলে শেষ না করে উঠবেন না। তার কবিতায় একটা সহজ ও বিশেষ ব্যাপার আছে। মনে হবে এ তো আমাদের গ্রামবাংলার কৃষিভিত্তিক নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনের স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। খুব সহজিয়া বর্ণনায় আমার গল্প অথবা আমাদের বিগত জীবনস্মৃতির কথাই বলছেন কবি। এমনকি কখনও কখনও কবিতাগুলো পাঠকের নিজস্ব গল্প হয়ে উঠছে। বলার ধরন এতই হূদয়স্পর্শী যে পাঠকের অন্দরমহলে প্রবেশ করে ভাবাতুর করছে পাঠককে। নতুন বাংলাদেশের অনেক পাঠকের কবিতা হয়তো এগুলো নয়। প্রায় বিগত বাংলার সামন্তবাদী কৃষিভিত্তিক জীবনের অনুল্লেখযোগ্য কিছু বিষাদ-মধুর স্মৃতি, যা একান্তই কবির মনে হলেও আসলে আমাদের অনেকেরই। কবিতায় উঠে আসা এই বিষয়টিকে আমাদের এই প্রজন্মের কবিতায় বেশ অভিনব মনে হয়েছে। ‘আম্মার আলমিরা’ কবিতায় বিধৃত বক্তব্য তো আমাদেরই তথা পাঠকদের অনেকের পুরোনো আলমিরা; গ্রামবাংলা থেকে উঠে আসা অসংখ্য নব নগরবাসীর আলমিরা, যে আলমিরাকে নিয়ে আমাদের অনেকের স্মৃতি এখনও দগদগে। কেমন একটা মায়াবী হাতছানি যেন পেছনে টেনে নিয়ে যাবে পুর্নবাসিত শহরের বিধিবদ্ধ নাগরিক পাঠককে। কবির আত্মজৈবনিক বিবৃতির মধ্য দিয়ে চিরায়ত বাঙালি পরিবারের একটি সেমিনার বলা যেতে পারে কবিতাটি। ‘চাচির দেখাদেখি একদিন আম্মাও আলমিরার বায়না করলে বাস্তুভিটার বুড়ো গাছটা চিরে আব্বায় একটা চলনসই আলমিরা তৈয়ার করে দেন। বাড়িতে এই প্রথম কোনো আভিজাত্য যোগ হওয়ায় আমরা খুব উৎসাহী হয়ে উঠি। কিন্তু আমাদের প্রত্যেককে ডিফিট দিয়ে আম্মাই তার দখল নিয়ে নেন।…অর্থাৎ আমরা বাপ-ছেলে বাদে সব খুব যত্নে লুকাতে শুরু করেন তিনি। এভাবে লুকাতে লুকাতে কখন যে আম্মা নিজেকেও আলমিরায় লুকিয়ে ফেলেছেন-আমরা আর তাকে পাইনি।’ অভাব আর বৈরিতার সাথে সংগ্রাম করে ব্যক্তিগত সংসার গোছাতে গোছাতে বাঙালি গিন্নিটি কখন যে আত্মকেন্দ্রিক বা নার্সিসাস হয়ে ওঠেন তা তারা টেরই পান না। কিন্তু হঠাৎ একদিন নিজের মুখোমুখি হলে বিগত সারল্যের পাশে তাকে বড্ড বেমান মনে হয়। এ কবিতায় তেমনই একটি দৃশ্যের মুখোমুখি হই আমরা।
একরাম আজাদের কবিতাগুলো একরকম তার বিগত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন। উল্লেখ্য ‘মাহে ভাদর’ কবিতায় গল্পের আদলে বলে যাচ্ছেন জীবনের কিছু তীব্র বেদনার অস্তগামী গল্প, যা প্রাত্যহিক কিন্তু অনুল্লেখিত। এখানে কবিতার অনুষঙ্গে চলে আসছে চিত্রকল্পের দৃশ্যগত চিত্রায়ণ, ব্যক্তিগত আক্রোশ, পিতা- পুত্রের চিরকালীন মতবিরোধ, সর্বোপরি আমাদের সামগ্রিক জীবনের ঝরঝরে প্রাকৃতিক বিবৃতি, পিতার ইবাদতের রম্যচিত্র, পরীক্ষা ফেইল করা শহরফেরত হতাশ পুত্রের বিপর্যস্ত মানসিক পরিস্থিতি-সুশৃঙ্খল ধার্মিক পিতার বোহেমিয়ান সন্তানের কাছে সবকিছুই যখন সার্কাসের নামান্তর। নিয়মবাদী পিতার উচ্ছৃঙ্খল কবি পুত্র চোখে-বুকে রাজ্যের সমস্ত হতাশা নিয়ে তখন বলে ওঠেন : ‘এরই মাঝে অসময়ে এক-একবার বেজে ওঠে উঠকো ফোন। কাকে বোঝাই এ বড়ো অসময়? উঠোনে একঝাঁক কুক্কুরীর মৌসুমি আর্তনাদ, অন্দরে আমার আমার বাপের। নিরুপায় জবাব দিই-‘দ্য ডগ ইজ বার্কিং’। বর্ণনাপ্রক্রিয়া বেশ সাহসী এবং বাস্তবিক বটে।
শৈশবের রূপকথার ফিনিক্স পাখির সাথে আমাদের পরিচয় না থাকলেও রাজপুত্রের ঘোড়ায় চড়ে বিশ্বজয় করার গল্প আমাদের কমবেশি অনেকেই জানি। এই প্রজন্মের শিশুরা হয়তো ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্রের ভুবনজয়ী কাহিনি জানবেই না। ‘ঘোড়া’ কবিতার প্রারম্ভিক নিবেদন হয়তো নবপ্রজন্মের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। তবে রূপকথার সেই ঘোড়া পরিণত যুবক কবির চিত্তে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত নতুন আবেদন পেশ করে। আস্ত একটি ফ্রয়েডকে যে কবি বুকে ও চোখে লেপে রাখেন তিনি তো এই ঘোড়াতে নবরূপ দেবেনই। রূপকথা এখন নিজেই নিজের জন্য তৈরি করছেন কবি তার ‘ঘোড়া’ কবিতায়। কবির এই ঘোড়া কামের দেবী হয়ে চারপাশে ঘুড়ে বেড়ায় কামুক তুলতুলে শরীর নিয়ে এবং কবির চোখজুড়ে বিচরণ করে সোনালি চুলের এই ঘোড়া, উদ্রেক ঘটে আদিম রসের।
এমন বেশকিছু দারুণ কবিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বাঁ পাশের শূন্য কাব্যগ্রন্থটি। প্রতিটি কবিতা ধরে ধরে বলতে গেলে আমার আলোচনাটি স্থূল পরিধির এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাঠকের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে ওঠার আশঙ্কায় আমি আর দীর্ঘায়িত করছি না। সামগ্রিক পাঠ থেকে বলতে পরি আজাদ তার সরল গদ্য বয়ানের কবিতাগুলোকে শিল্পিত শব্দচয়ন ও চিন্তার নতুনত্বে সফলভাবে কবিতা করে তুলতে পেরেছেন। বিশেষত তার কবিতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো পাঠকের চিন্তায় দাগ কেটে যাওয়ার মতো তীব্র এবং তার কবিতার ভাষা তাকে আলাদাভাবে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য করবে বলে আমি মনে করি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম
পরবর্তী নিবন্ধমেক্সিকোর সৈকতে তানজিন তিশা