আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে সাহায্য করি

ইন্দ্রাণী পাঠক | বৃহস্পতিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

যাপিত এই জীবন চলছে প্রত্যেকের নিজস্ব নিয়মে। নিয়ম অভ্যস্ত করাও যেন নিজের দিক নির্দেশনা। সঠিক নিয়ম ক’জনই বা মেনে চলি! আসল কথা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা সমাজে যে জীবনযাপন করছি তা সামাজিকীকরণ। এটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উপাদান, বিভিন্ন প্রযুক্তি মাধ্যম আমাদের সাহায্য করে সামাজিকভাবে বেড়ে উঠতে। আমাদের এই সাহায্যকারী উপাদান, প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমগুলো কিভাবে আমরা ব্যবহার করছি? শিক্ষা এক্ষেত্রে অগ্রজ ভুমিকা রাখে। একজন শিশু পরিবার থেকেই প্রথম শিক্ষা পেয়ে থাকে। পরিবারের ব্যক্তিবর্গের আচরণ শিশুকে প্রভাবিত করে। সমাজে এই শিশু ধীরে ধীরে কিশোর, যুবক, তরুণ, বৃদ্ধ এই শ্রেণিগুলো পার হয়।
আমরা ভদ্রতা, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ ইত্যাদি আচরণিক গুণাবলী পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাই। তাই এর সুশৃঙ্খলতা সঠিকভাবে বজায় রাখা আমাদেরই দায়িত্বে পড়ে। ধরুন প্রায়ই দেখা যায় বিদ্যালয়, কলেজ যে সময় শুরু হয় তখন কোনটি অধিক জরুরি? জরুরি হলো শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বিদ্যালয় বা কলেজ আঙিনায় প্রবেশ করতে দেয়া। তা না করে সমাজের মানুষ কী করে? বিদ্যালয় বা কলেজ গেটে আড্ডাস্থল বা গাড়ি পার্কিং করে যানজট সৃষ্টি করে। সেখানে এমনসব কথা হয় যখন একজন শিক্ষার্থী প্রবেশ পথে সেই কথা শোনে এবং প্রভাবিত হয়।
এ তো গেলো কিছু দিক। এরপর আসি আচরণ, ব্যবহারগত দিক নিয়ে। সেখানেও এই প্রতিষ্ঠান, উপাদান, মাধ্যম কাজে আসে। সকলেই শিক্ষিত কিন্তু কতজন মার্জিত? মানুষ মাত্রই ভুল। ভুল স্বীকার করে সংশোধন যে হয়, নম্রতার সাথে কথা বলে যে নিজের অপারগতা স্বীকার করে ক্ষমা চায় সে বিনয়ী। কিন্তু আমরা কী করি? তার বিনয়কে দুর্বলতার কোটেশনে বিভক্ত করে নিজের মূর্খতা প্রকাশ করি। আমরা কি বুঝি সেটা? কেউ বুঝি আবার কেউ বুঝি না। না বোঝার দলে লোকের সংখ্যা বেশি। আপনি পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের মুখ্যব্যক্তি। অনুজ হিসেবে অগ্রজের কাছ থেকে শেখা এটাই তো স্বভাবিক তাই না? আমরা কি করি? আমরা যা করি বেশিরভাগ মানুষ তা হলো আপনার যাকে ব্যক্তিগত পছন্দ নয় তাকে কথা দিয়ে, কাজ দিয়ে, সরাসরি নানাভাবে মানসিক, শারীরিক কষ্ট দেই। আপনি ভাবছেন এতে তার শিক্ষা হচ্ছে? একদমই না, কখনোই না। আগেই বলেছি, মানুষরের ভুল হয়। তিনি যদি সংশোধন করেন নিজেকে তাহলে আপনার উচিত তাকে সম্মানিত করা আর যদি সংশোধন না করেন তাহলে তাকে স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা দিয়ে শেখানো। এমন নয় আপনার আমিত্ব দেখাতে গিয়ে সেই ভুল করা মানুষটির দৃষ্টিতে আপনি ছোট বা নগণ্য হয়ে না যান। বিনয়ী মন, বিনয়সুলভ কথা, প্রশংসা, ভালো দিক তুলে ধরা ঐ অনেক ভুল ভরা মানুষটির জীবনে যেমন পরিবর্তন আপনি এনে দেবেন ঠিক তার দৃষ্টিতে আপনি অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে মনে গেঁথে থাকবেন আজীবন। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলার আগে যাচাই করবেন আদৌ তিনি কি সে ধরনের? তার পূর্বের আচরণ বা কাজ কি নেতিবাচক? অন্যের কথা শুনে আমরা বিচারক হয়ে দ্রুত রায় দিয়ে ফেলি। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান নয় ঠিকেই পৃথিবী নামক গ্রহে বিচিত্র শ্রেণির, পেশার মানুষ আছে। একটু ভাবুন, সঠিক মূল্যায়ন করুন। এমন কথা সকলের সামনে বলে বসবেন না যা ঐ মানুষ বা শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ যাই হোক তিনি নিজেকে শুণ্যের কোঠায় না নিয়ে আসেন। কিছু বলার হলে তাকে আলাদা ডেকে বিনয়, সম্মান, স্নেহ, মমতা দিয়ে বোঝান। এক্ষেত্রে শিশু ও বৃদ্ধ ব্যক্তি ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ। তারা ভালোবাসা চায়। তাই দিন। এতে আপনার বা আমার পকেট থেকে কোনো টাকা খরচ হবে না। তাদের হাসিমাখা মুখ আপনাকে কোটি টাকার চাইতেও বেশি সুখ দেবে।
বর্তমান এই যান্ত্রিক যুগে যানবাহন ছাড়া আমরা চলতেই পারি না। ভেবে দেখুন, আপনি বিশেষ কোনো কাজে দ্রুত রিঙা বা অটো করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ট্রাফিক জ্যামে আমরা জর্জরিত। এতে চালকের কী দোষ বলুন কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে তাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করি। কখনো কি বোঝার চেষ্টা করেছেন তারাও আমার আপনার মত মানুষ! তাদের পরিবার বা তারা কেমন আছে, তাদের সন্তান কি পড়ছে এসব কি জিজ্ঞেস করেছেন? কেউ করেছেন আর বেশিরভাগ মানুষ করেন না। তাদের ৫/১০ টাকা বাড়তি চাইবার জন্য গালমন্দ, গায়ে হাত তোলা এ ধরণের কাজ হয়ে থাকে। সেখানে যদি আপনার পাশে আপনার শিশু বসা থাকে সে কি দেখলো আর কি শিখলো বলুন তো! পেটের দায়ে কেউ রিঙা, অটো ইত্যাদি যানবাহন চালায় আবার কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করে। তাদের সম্মান করুন। সামর্থ্য থাকলে তাদের পরিবারকে সাহায্য করুন। আবার বাসে যখন উঠতি বয়সের মেয়েরা ওঠে তখন বাস কন্ডাক্টর বিভিন্ন অশালীন ভাবে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে বাসে ওঠায়। কখনো কি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন? যারা করেন নি করবেন, এমনকি আপনার, আমার মত ভদ্র শিক্ষিত লোক যখন নেতিবাচক মন, দৃষ্টিতে বাসে মেয়েদের লাঞ্চিত করে তখন প্রতিবাদ করুন, আইনের সাহায্য নিন। শুধু বাস কন্ডাক্টর নয়, আমাদের ভদ্র সুশীল মানুষ এসব বেশি করে। আজ আপনি করছেন আগামীতে আপনার প্রজন্ম করবে। নিশ্চয় আপনি তা চান না। রাস্তায় মানসিক বিকারগ্রস্ত অনেক মানুষ দেখা যায়। তাদের পরনে কাপড় থাকে না কিন্তু আমরা কী করি? তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে হাসাহাসি করি কেউবা এর সুযোগ নিয়ে সেই অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে নিজের বিকৃত লালসা মেটাই। এই কি আমরা শ্রেষ্ঠ জীব! এমনকি পশু পাখিকে অযথা কষ্ট দেই বিভিন্নভাবে পাথর মেরে। কী করেছে ওরা আপনার? একটু মানবিক হোন, সামাজিক হোন। প্রকৃতি কী না দিয়েছে আমাদের! অথচ আমরা গাছপালা কাটি, বন উজার করছি। এতে তো আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশে আবর্জনা ফেলে সকলের ক্ষতি করছি। নিজের পায়ে পাগলও কুড়োল মারে না অথচ আমরা কি করছি?
প্রযুক্তি ব্যবহার বর্তমানে অপরিহার্য। বিশেষ করে এই করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল বা ল্যাপটপ তুলে দিতে হচ্ছে পড়াশোনা চলমান রাখার জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবক বলেন, তাদের সন্তান অনলাইন ক্লাস না করে গেইমস খেলে, অন্য সাইটে প্রবেশ করে নেতিবাচক দিক দেখে। দেখুন সন্তান আপনার ঘরে, সে কি করছে না করছে সেটা দেখার দায়িত্ব আপনার, সাথে শিক্ষকের তো অবশ্যই। শিক্ষক যখন অনলাইন ক্লাসে ভিডিও অন করতে বলেন তখন অজুহাত আসে নেটওয়ার্ক নিয়ে। মেনে নেন শিক্ষক সেটা কিন্তু অভিভাবকদের যখন সমালোচনা আসে শিক্ষক কিছু দেখছে না তখন বিষয়টি কী দাঁড়ায় বুঝুন। অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির হার খুব কম। কেন? অভিভাবকদের মুখের কথা ‘আমার ছেলে বা মেয়ে ঘুম থেকে উঠতে পারে না, এমনকি শিক্ষার্থী নিজে বলে স্যার/ ম্যাম আমি ঘুম থেকে উঠতে পারিনি’… বলুন কি করা যায়? আচ্ছা বিদ্যালয়, কলেজ খোলা থাকলে কি আপনি বা আপনার সন্তান এ ধরনের কথা বলার সুযোগ পেতো? করোনাকালীন সময়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছে তারা যাতে পড়াশোনার সাথে থাকুক। অথচ সেই অ্যাসাইনমেন্ট পেতে শিক্ষকদের নাস্তানাবুদ হতে হয়। শিক্ষার্থী অসুস্থ থাকলে সেটি অন্য ব্যাপার। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী সময়ের অ্যাসাইনমেন্ট সময়ে জমা দেয় না ১৫/ ২০ দিন এমনকি একমাস পরে এসে ১নং অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে যেখানে ১৭ নং অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেয়া হচ্ছে। কী শিখছে সন্তান? আপনি, আমি, আমরা পারি তাদের স্বাভাবিক ভাবে চলতে সাহায্য করতে। প্রয়োজনে কঠোর হোন সেটা নিয়মের মধ্যে। আপনার সন্তানের বন্ধুদের খোঁজ রাখুন তারা কাদের সাথে মিশছে। তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখুন তাও নির্দিষ্ট সীমা রেখে। প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে তাদের বিনোদন কেড়ে নেবেন না। সময় নিয়ে তাদের বেড়াতে নিয়ে যান। অল্প আনন্দ বৃহৎ কার্যের সূচনা ঘটায়। গোল্ডেন প্লাস, জিপিএ ৫ জরুরি তার সাথে গোল্ডেন মানুষ তৈরি করা আপনার, আমার, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে। বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে যাওয়া খুব সহজ কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া কষ্টকর। তাই সামাজিক মানুষ, রাষ্ট্রীয় নাগরিক হিসেবে আমাদের সমাজের সন্তান, বিভিন্ন বয়সের মানুষদের সচেতন পথে নিয়ে যেতে আমরা বিভিন্ন প্রশাসন শ্রেণি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান কার্যকরী পদক্ষেপ নেবো এটাই কাম্য। উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ শিক্ষিত, মানবিক, নৈতিক, মূল্যবোধ শ্রেণির নাগরিক গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। আসুন আমরা বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সেই দিকে ধাবিত হই এবং আগামীর সুযোগ্য প্রজন্ম নাগরিক শ্রেণি গড়ে তুলতে সাহায্য করি।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) : একজন সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব
পরবর্তী নিবন্ধজানুয়ারিতে রপ্তানি আয়ে ৪১% প্রবৃদ্ধি