হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) : একজন সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব

ড. মো. মোরশেদুল আলম | বৃহস্পতিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

হযরত শেখ সৈয়দ শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) এমন এক মানবকল্যাণকামী মনীষী যাঁর সমগ্র জীবন মানবতার জন্যই নিবেদিত। জীবদ্দশায় যেমন ছিলেন, তেমনি ওফাতের পরও তিনি মানবকল্যাণে নিবেদিত। তিনি প্রেম ও অবলীলামুক্ত অন্তরে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক প্রেরণার সত্য ও সৌন্দর্যস্বরূপ।
শত শত বছর ধরে লোক পরম্পরায় জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে, অলিকুল শিরোমনি, মুশকিল কোশা, হাযত রাওয়া হযরত সৈয়দ শাহজাহান শাহ্‌ (রা.)-এর জন্ম আরবের ইয়েমেনে। আরব, ইরাক, ইরান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু নবী-প্রেমিক ব্যক্তিগত জীবনের সকল প্রকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রাচ্যে আগমন করেন। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে কষ্টকর জীবন বরণ করে তাঁরা মহান ইসলামের সার্বজনীন শান্তি-ছায়া বিস্তারপূর্বক দুর্গত মানবতার সেবা, নিরাপত্তা ও সামগ্রিক কল্যাণ সাধনে ব্রতী হন। হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) তেমন একজন সর্বত্যাগী ওলী, যিনি প্রগাঢ় খোদায়ী নূরে উদ্ভাসিত এক বিরাট হৃদয় নিয়ে নিজের জন্মভূমি ইয়েমেন থেকে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামেই তিনি ইসলাম প্রচার ও মানবতার খেদমত করে মহিমাময় জীবন অতিবাহিত করেন।
জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে লিখিত নিবন্ধনাদি ও তথ্যে বর্ণিত আছে যে, তিনি ইয়েমেন থেকে স্থল ও জল পথ ধরে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর লাহোর-দিল্লী-গৌড় হয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার তদানীন্তন ‘ইল্লা’ নামক স্থানে ডিঙ্গি নৌকা থেকে অবতরণ করেন। ঐ স্থানে মাটিতে পদার্পণ করে তিনি কালেমা উচ্চারণ করে মাটিতে স্বীয় হাতে থাকা লাঠি স্থাপন করেন। তাঁর পবিত্র জবানে উচ্চারিত কালেমার সূত্র ধরে ঐ স্থানটি লোকমুখে ‘ইল্লা’ নামে পরিচিত। তিনি ঐ স্থানে কিছুকাল অবস্থান করে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত কাটিরহাটে আগমন করে পাশ্ববর্তী ‘মোগল কিল্লা’ নামক স্থানের ‘কোডের পাড়ে’ এসে তাঁর আস্তানা তৈরি করেন। স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়দুল হক বলেন, এই কোডের পাড় ছিল মূলতঃ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কোডের পাড়ের বুক চিরে যাওয়া রাস্তার দক্ষিণ পাশে জঙ্গলের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় ‘ফইরের টাইক্কা’ অর্থাৎ ফকিরের তাকিয়া অবিস্থত। সেখানে টিনের ছাউনি দিয়ে মাটির দেয়াল দ্বারা নির্মিত ঘরে হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) ফকিরের মতো একটি কাঁথা জড়িয়ে থাকতেন বলেই তাঁর ঐ আস্তানাটিকে ‘ফকিরের তাকিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ কর্তৃক ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিজয়ের পর আরব, ইয়েমেন, পারস্য, আফগানিস্তান ও তুরস্ক থেকে অনেক মুসলিম সুফি সাধক চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অধ্যাপক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া এক নিবন্ধে লেখেন, ‘চতুর্দ্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ্‌ চট্টগ্রাম দখল করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে তা স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে এই অঞ্চল আবার ত্রিপুরা ও আরাকান রাজার দখলে চলে যায়। ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ’র চট্টগ্রাম অভিযানের উপর ভিত্তি করে চতুর্দ্দশ ও পঞ্চদশ শতকে চট্টগ্রামে বহু সুফি সাধকের আগমন ঘটে। তন্মধ্যে হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) একজন উচ্চ মার্গের অলি ও সুফি সাধক ছিলেন। সুফিগণের আগমনে চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে এবং সুফিদের ধ্যান-সাধনায়, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে অনেক লোক ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তারা তা গ্রহণ করে। সুফিরা আধ্যাত্মিক সাধক। আধ্যাত্মিক সাধনায় উচ্চ মার্গের উন্নীত সাধক ইচ্ছে করলে অলৌকিকভাবে মানবজগতের উপকার সাধন করতে পারেন। আমার যা অনুভূতি তাতে মনে হয়, হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) সেই রকম আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে মানসিক বিভিন্ন উন্নত স্তরে পৌঁছেছিলেন। যার জন্য তিনি ‘জিন্দা অলি’ নামে পরিচিত।’
প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়দুল হক তাঁর ‘জঙ্গল মে মঙ্গল’ নিবন্ধে লেখেন, হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) কোডের পাড়ের এই জঙ্গলের মধ্যে একটা বটগাছের নীচে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বসে থাকতেন। কখনও তাঁর দুই পাশে এবং সামনে কয়েকটা বাঘ বসে তাঁর দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকত এবং পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বাঘ হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (র.)-এর কনিষ্ঠ আঙ্গুলী লেহন করত। তখনকার ‘ফইরের টাইক্কা’ থেকে পাহাড়ের দূরত্ব ছিল মাত্র এক থেকে দেড় কিলোমিটার। বাঘ স্বল্প সময়ের মধ্যে পাহাড় থেকে তাঁর নিকট আসা-যাওয়া করতে পারত। বাঘ লোকালয়ের পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করলেও কখনও কারো কোনো ক্ষতি করেনি। হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.)-এর পদধূলি পেয়ে ধন্য ‘কোডের পাড়কে’ ‘কোটের পাড়ও’ বলা হয়ে থাকে। উক্ত কোটের পাড়ের পাশে একটি হাট গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে ‘কাটিরহাট’ নামে রূপান্তর ঘটেছে। কাটিরহাট সংলগ্ন ফকিরের তাকিয়ার এই আস্তানায় বসে তিনি এই অঞ্চলের ইসলাম প্রচার-প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পরলোকগমন করেন।
গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. এ এস এম বোরহান উদ্দীন লেখেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে সুফিয়ায়ে কেরামের আগমন নির্গমন ঘটে। এ ক্রমধারায় আলোকোজ্জ্বল সংযোজন হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.)। সূর্যের আলোয় গহীন অন্ধকার যেভাবে মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায় তেমনি এ মহান অলিয়ে কামেলের পদচারণায় সাম্য, মানবতা, শিক্ষা, প্রেম-মমতার স্নিগ্ধ কিরণে সমকালীন সমাজ মানস ও জীবন হয়ে উঠেছে উদ্ভাসিত।’ সুফি সাধকরা কেবল তাঁদের আত্মোৎকর্ষ লাভের জন্যই নিজেদের নিয়োজিত করে না, তাঁরা ইসলামের জন্য এবং মানবসেবার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। মানবসেবাকে তাঁরা স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও নিষ্ঠারূপে বিবেচনা করে থাকেন। মহান সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) এমন এক সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যাঁর জীবন ও কর্ম মানবতার জন্য উৎসর্গীত। অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান চৌধুরী তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই মহান ওলীকে বার আউলিয়ার একজন হিসেবে মনে করা হয়। তাঁর আদি নাম শেখ জানি শাহ বলেও কোনো কোনো মহলে জনশ্রুতি আছে। তিনি যে একজন মস্তবড় ওলী আল্লাহ ছিলেন এতে কারো দ্বিমত নেই। তাঁর বিভিন্ন কারামত তাঁর শান ও মান সম্পর্কে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য প্রদান করে।’
পরিশেষে ড. এ এস এম বোরহান উদ্দীনের বক্তব্য দিয়েই নিবন্ধটি শেষ করতে চাই। মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও সার্বিক কল্যাণে হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.) ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক আলোকবর্তিকা। তাঁর সত্যাসন্ধ আদর্শ, কল্যাণ, কাশফ, আধ্যাত্মিকতা, কর্মপ্রক্রিয়া, অপূর্ব চরিত্রমাধুরী সর্বোপরী ঈমানী মহিমায় এ অঞ্চলের মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সৃষ্টি করেছিলেন আলোড়ন। ভক্তদের হৃদয়ে আশা, সাহস ও আস্থার অনির্বাণ প্রদীপরূপে তাঁর মাজার শরীফককে আবর্তিত করে যে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা, মানবসেবামূলক কর্মধারা প্রবর্তিত হচ্ছে তা আমাদের সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সহায়ক হবে। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনে ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধআচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে সাহায্য করি