আগুন লাগল-ছড়াল কীভাবে

যা বললেন লঞ্চের সুপারভাইজার

| রবিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ভোর রাতে যখন মাঝ নদীতে লঞ্চ, তখন প্রথম নিভে গেল বাতি, এরপর লাগল আগুন, অন্ধকারে পথ হাতড়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বাঁচালেন আনোয়ার হোসেন। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক অগ্নিকাণ্ডের যে অভিযান-১০ লঞ্চ পুড়ে অঙ্গার হলো, সেই লঞ্চে সুপারভাইজার ছিলেন আনোয়ার।
যতদূর জানা গেছে, ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল। লঞ্চের ইঞ্জিনে ত্রুটি, তাতে গা না করা, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম ব্যবহার না করা, নানা অভিযোগ উঠছে। আসলে কী ঘটেছিল? জানতে লঞ্চটির মাস্টারের দায়িত্বে থাকা খলিলুর রহমান এবং ইঞ্জিন কক্ষের দায়িত্বে থাকা আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে কথা বলা গেছে লঞ্চের সুপারভাইজার আনোয়ারের সঙ্গে। গতকাল দুপুরে তিনি বলেছেন, অগ্নিকাণ্ড তিনি কাছ থেকে যেভাবে দেখেছেন। খবর বিডিনিউজের।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সদরঘাট থেকে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল এমভি অভিযান-১০। চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাট পেরিয়ে লঞ্চটি যাচ্ছিল বেতাগী, শেষ গন্তব্য ছিল বরগুনা। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের বর্ণনা অনুযায়ী, শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন ঘুমে। রাত ৩টার দিকে কোনো এক সময় লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হয়।
বাতি নেভার পর আগুন : আনোয়ার বলেন, ঘটনার সময় তিনি নিচতলার পেছনের একটি টয়লেটে ছিলেন। টয়লেটে থাকা অবস্থায় বাতি বন্ধ হয়েছে যায়। তাড়াতাড়ি বের হয়ে জানতে চান, বাতি বন্ধ হলো কেন? তখন তিনি তিনটি জেনারেটরের একটি চালু করতে যান। তখন দেখতে পান ইঞ্জিন রুমে আগুন।
আনোয়ার বলেন, ড্রাইভার কালাম আর গ্রিজারম্যান সুমন দৌড়ে বলতেছিল ‘বোতল কই, বোতল কই (অগ্নিবির্বাপক যন্ত্র)’। সুমন বলতেছিল, অন্ধকারে কিছু দেখতেছি না।
আনোয়ার বলেন, আমি সামনেও যেতে পারছি না আগুনের কারণে। সুমনকে বলি অন্যদের ডাকতে। সুমন একটু পরে বলে, কাকা আগুন তো দোতলায়ও জ্বলছে। এটা শুনে অবাক হয়ে গেছি। কী রে ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন বের হতে পারল না, আবার দোতলায়ও জ্বলছে! দোতলায় আগুনের কথা শুনে আমার মাথা আর কাজ করতেছিল না। আমি লঞ্চে আরেক সাইড ধরে সামনে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু না, সেখানে সামনে যাওয়ার মতো আর পথ ছিল না আগুনের কারণে। লোকজনের কাঁউ মাঁউ, আলো নেই, লঞ্চের সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে। বারবার অবাক হচ্ছিলাম এটা ভেবে, নিচতলার আগুন ইঞ্জিন রুম থেকে বের হতে পারল না, কিন্তু দোতলা ও তিনতলায় আগুন! এটা কী করে সম্ভব?
ভয়ঙ্কর ওই অগ্নিকাণ্ডকে ‘রহস্যজনক’ বলছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি এর আগে বলেছিলেন, এভাবে আগুনটা ছড়িয়ে যাবে, আমার কাছে বিষয়টি অ্যাবনরমাল মনে হয়েছে।
লঞ্চের কেবিন ও অন্যান্য বাতি ও ফ্যান চলে জেনারেটরের মাধ্যমে, আর ইঞ্জিনের শক্তিতে চলে লঞ্চ। তাহলে জেনারেটরে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল কিনা, সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি আনোয়ার। যখন আলো নিভে গেল তখন ইঞ্জিন চালু ছিল কিনা, তাও স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইঞ্জিন কক্ষের ভেতরে একটি, বাইরে দুই পাশে দুটি করে চারটি ছিল। অন্য স্থানে আরও ছিল। কিন্তু অন্ধকারে ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতি ছিল না।
তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা ছিল : যাত্রীদের অভিযোগ, আগুন জ্বলার পর এগিয়ে যেতে থাকে অভিযান-১০, এক পর্যায়ে পুরো লঞ্চ পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। লঞ্চটি তখন ঝালকাঠির দিয়াকুল গ্রামের পাশে।
আনোয়ার বলছেন, লঞ্চের মাস্টার তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। ইঞ্জিন বন্ধ করে মাস্টার খলিল বুদ্ধি করে তীরের কাছাকাছি আনে লঞ্চটি। কিন্তু তীরে ধাক্কা খেয়ে আবার মাঝ নদীর দিকে ভেসে যায়। তখন অনেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা পায়। লঞ্চ ভাসতে ভাসতে ঝালকাঠির কাছে নদীর ওপারে চলে যায়। আধা ঘণ্টা পর স্থানীয়রা দুটি ট্রলার নিয়ে এগিয়ে আসে এবং ওই দুই ট্রলারেও কিছু মানুষকে উদ্ধার করে।
ট্রলার দুটি লঞ্চের নিচের ডেকে কিংবা সামনে যারা ছিল, তাদেরকে উদ্ধার করতে পেরেছে। কারণ দোতলা বা তিনতলায় কেবিন বা পেছনে যারা আটকা পড়েছিল, তাদের নামার কোনো সুযোগ ছিল না। আপনি কীভাবে নেমেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তীরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চ যখন মাঝ নদীর দিকে যাচ্ছিল। তখন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে তীরে আসি।
লঞ্চের অন্যান্য কর্মীদের খবর জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, মাস্টার রিয়াজ আর মাস্টার খলিলুর রহমান, ড্রাইভার কালাম, সুমনসহ যারা অন ডিউটিতে ছিল, তারা সবই বের হতে পেরেছে। তবে ড্রাইভার মামুন বিল্লাহ, লস্কর জুয়েল ও বাবুর্চি শাকিলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এর মধ্যে রিয়াজ ও খলিলের সঙ্গে গতকাল থেকে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে তিনি জানান।
বিস্ফোরণ ঘটেছিল? : ইঞ্জিন রুমে একটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা যাত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন। লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ বলেছিলেন, আনোয়ার ভোরে আগুন লাগার খবর দেওয়ার সময় ইঞ্জিনের একজস্ট পাইপের কাছে বিস্ফোরণের কথা তাকে জানিয়েছিলেন।
বিস্ফোরণের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, টয়লেটে যখন ছিলাম, তখন দুম করে একটা শব্দ হয়েছে। তখন মনে করছি কিছু পড়ে বা অন্য কোনো শব্দ। আগুন লাগার বেশ কিছুক্ষণ পর লঞ্চ ভাসতে ভাসতে যখন মাঝ নদীতে গেল, তখন আরেকটা শব্দ হয়েছে।
নিচের ডেকের ইঞ্জিন কক্ষের পাশেই ছিল লঞ্চের ক্যান্টিন। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার ‘বিস্ফোরিত হয়ে’ আগুন লেগেছে বলে এক কেবিন বয় দাবি করেছিল। তার ভাষ্য, এরপর সেখানে রাখা ১৩ ব্যারেল ডিজেল আগুন বাড়িয়ে দেয়।
তবে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার ধারণা সঠিক নয় বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল বিভাগীয় প্রধান মো. কামাল হোসেন। তিনি ঘটনার পর বলেছিলেন, এই তথ্য সত্য নয়। আমি নিজেই ইঞ্জিন কক্ষের কাছে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় দেখেছি। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো চিহ্ন আমরা সেখানে দেখিনি।
ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না দাবি করে লঞ্চ মালিক হামজালাল শেখ বলেন, নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে চলতি মাসেই সার্ভিসে নামে তার লঞ্চ। দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাটসু ইঞ্জিন লঞ্চটিতে লাগানো হযেছিল। ইঞ্জিনরুম বেশি পুড়েছে কারণ সেখানে ছিল ছয় হাজার লিটার তেল।
যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চের ইঞ্জিন পথে নষ্ট হয়েছে এবং দুইবার ঠিক করতে হয়েছে। এ বিষয়ে আনোয়ার বলেন, এ কথা ঠিক না। বরিশাল ছাড়ার পরে কুয়াশার কারণে ইঞ্জিনকে ‘ট্রবের’ (নিউট্রাল) করলে মনে হয় ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আসলে গিয়ারের উপরে রেখে খুব আস্তে চালানো হচ্ছিল। নতুন ইঞ্জিন তাই সাড়ে ৬শ এইচপি থাকা সত্ত্বেও সাড়ে চারশ এইচপিতে লঞ্চ চালানো হয়েছে। সব সময় দুইশ এইচপি হাতে রেখেছি, যাতে ইঞ্জিনের উপর চাপ না পড়ে।
পথে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক জোরে বা বিকট শব্দ হয়েছিল-যাত্রীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, লঞ্চে গতি থামাতে বা পেছনে ব্রেকার দিতে গেলে জোরে শব্দ হয়। এখন যেহেতু দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই কত কথা শুনছি এখন। আসলে ইঞ্জিনের কিছুই হয়নি। মানুষ না বুঝে শুধু শুধু কথাগুলো বলছে। তিনি পাল্টা প্রশ্নে বলেন, ধরে নিলাম ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হলো। যদি তাই হয়, সুমন ও কালাম কীভাবে বের হলো?
তৃতীয় যাত্রায় দুর্ঘটনা : আনোয়ার জানান, নতুন ইঞ্জিন নিয়ে লঞ্চটির তৃতীয় যাত্রায় এই অগ্নিকাণ্ড ঘটল। রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন লাগানোর পর আগে চরমোনাইয়ে ভাড়ায় গিয়েছিল, আরেকবার বরগুনায় গিয়েছিল। রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন কেন লাগানো হয় জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, নতুন ডায়হাটসু ইঞ্জিন আমদানি করতে ৫০ কোটি টাকা লাগবে। তাই জাহাজের রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন কিনে ওভার হোলিং করে লঞ্চে লাগানো হয়। চীন থেকে ২৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা নতুন ইঞ্জিন কেনা গেলেও সেই ইঞ্জিন ভালো নয় এবং সার্ভিসও ভালো পাওয়া যায় না। তাই সব লঞ্চে রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু ফেব্রুয়ারিতে
পরবর্তী নিবন্ধধোপাছড়িতে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৫