আগস্ট ট্র্যাজেডি : অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম জামাল উদ্দিনের সুলকসন্ধান

আবু মুসা চৌধুরী | শুক্রবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

‘প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিলো, তার অনুসন্ধান ও এর সত্য বিকিরণই ইতিহাস।’ তাই সত্যের সারবত্তা নির্ণয়ে ঐতিহাসিকের সততাই মুখ্য। যদিও ঘটনা-পারম্পর্য-কার্যকরণ নির্ণয়ে অনেক সময় জনশ্রুতি, গল্প-গাথা অতিশয়োক্তির প্রবেশ স্বাভাবিক, তবুও বস্তুনিষ্ঠতার খাতিরে ইতিহাসবেত্তার পক্ষপাতমুক্ত নিরপেক্ষ নিস্পৃহ অবস্থান এবং স্বকীয় দায়বদ্ধতাও জরুরি।

এ-প্রসঙ্গ উঠে এলো এ-কারণে যে, প্রত্নসন্ধানী-খ্যাতিমান ইতিহাস রচয়িতা জামাল উদ্দিন-এর অধুনা-প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আগস্ট ট্র্যাজেডি: অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম’ বাংলা ও বাঙালির স্মরণকালের বিয়োগান্ত পর্বের সুলুকসন্ধান।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে এক বর্বরোচিত-পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের অনিঃশেষ বেদনাবহ দিন। সকলের জ্ঞাত যে, বাঙালির জাতির পিতাকে সেদিন সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। রক্ষা পায়নি তাঁর শিশুপুত্র ও নব-বিবাহিতা পুত্রবধূরাও। এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় হতে পারে কারবালার খুন-ঝরা ইতিহাস।

যুদ্ধ মানেই যতোই ‘শত্রু শত্রু খেলা’ হোক, তবুও যুদ্ধের একটি প্রকরণ বিধি-বিধান-সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু আগস্ট ট্র্যাজেডি সবকিছু ম্লান করে দিয়ে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আর একটি জেনোসাইডে রূপান্তরিত হয়েছিলো।

তো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, বাঙালি ঝলসে না উঠলেও ক্ষীণ পরিসরে প্রতিবাদী হয়েছিলো। ঢাকায় প্রথম মিছিল বার হয়েছিলো, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে। এবং তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরদিন।

আগস্ট ট্র্যাজেডির পর, বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় সৈনিকরা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। বাঘা সিদ্দিকী নামে খ্যাত কাদের সিদ্দিকী ঘর থেকে বার হয়ে গিয়েছিলেন। হাতে তুলে নিয়েছিলেন ৭১-এর মতো আবার অস্ত্র। বীর প্রসবিণী চট্টলাও কাপুরুষের মতো স্থবির-নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেনি। তখন তরুণ তুর্কি মৌলভী সৈয়দ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী জাতির রক্তঋণ শোধ করার জন্যে বারুদগন্ধ বুকে ধারণ করে মৃত্যুনদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের অনুসারী বঙ্গবন্ধুর সূর্যসন্তানদের নিয়ে। আরেক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশায় পাড়ি দিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, জেলা-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন।

ইতিহাসের এই গৌরবগাথা জনসম্মুখে তুলে ধরে জামাল উদ্দিন জাতীয় দায় সম্পাদন করেছেন। তাঁর জবানি- ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিবাদকারীদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের আলোকে কোনো গ্রন্থ আমাদের সামনে লিপিবদ্ধ নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থিত হওয়া প্রয়োজন মনে করে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এ-প্রসঙ্গে তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও প্রয়াত মৌলভী সৈয়দসহ আরো অনেক সিনিয়র নেতার দ্বারস্ত হয়েছিলেন। এছাড়া যারা সক্রিয়ভাবে এই মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ সৈনিক, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেও তিনি বিশদ জেনেছেন। কেননা ‘জীবন্ত তথা-উপাত্ত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগেই ইতিহাস রচনার তাড়নায় তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার এই অমানুষিক কষ্টের ফসল এই গ্রন্থ।

অত্যন্ত প্রাঞ্জল গতিশীল গদ্যে জামাল উদ্দিন এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেহেতু সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ-রচনা, তাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিক। কিন্তু থ্রিলারের মতো রোমহর্ষ এবং কুশীলবদের মিশন ও ভিশন তথা অনমনীয় দেশপ্রেমের কারণে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করেই এই বই পাঠ করা যায়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ৭৫-এর আগস্ট ট্র্যাজেডির পর চট্টগ্রামের আওয়ামী পরিবার যেমন ফুঁসে উঠেছিলো, সমান্তরালে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাও ছিলো বিস্তৃত। আশা করা যায় পরবর্তী সংস্করণে তা সংযোজিত হবে।

অত্র গ্রন্থে ব্যাপক মাঠ-সমীক্ষা বা ক্ষেত্র জরিপের প্রমাণ সুস্পষ্ট। আর এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কেননা পরিশ্রমী গবেষক জামাল উদ্দিন- যার ইতিহাস চর্চার পাঠ শুরু হয়েছিলো ইতিহাসবেত্তা ড. আবদুল করিম ও ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর পক্ষছায়ায়। তিনি গবেষণার কাজে শুধু পাঠনির্ভর নন, ইতিহাসের তথ্য-উপাদান-সংগ্রহের জন্য স্বশরীরে গিয়েছিলেন পাবর্ত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে, এমনকি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, কলকাতা, দিল্লি অবধি। মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর হাতে পড়ে কারান্তরীণও হয়েছিলেন।

চট্টলমাটির এই ভূমিপুত্রের এক দালিলিক সম্পদ এই ‘আগস্ট ট্যাজেডি : অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম।’

যদিও ‘ঘটে যাওয়া ঘটনাই ইতিহাস।’ এবং যা বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ ও যোগসূত্র। এ-নিরিখে ভবিষ্যতেরও আকর এই গ্রন্থ। তাই জামাল উদ্দিন-এর এই সনিষ্ঠ প্রয়াস আগামীর জন্য দিক নির্দেশনাও বটে। বরেণ্য রাজনীতিক নঈম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে একাত্ম হয়ে বলা যায়- চট্টগ্রামের মেহনতি মানুষের প্রতিবাদী নেতা মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্মীদের সাথে নিয়ে জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন, তা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।’

গ্রন্থটির অর্থবহ শিল্পিত ও যুক্তিযুক্ত প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস। প্রচ্ছদে কালো-লাল-শাদার-বর্ণ-দ্যোতনা এবং নিচের ফ্রেস্কো অন্যরকম মাত্রায় যোজিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচিত কবিতা: আদিবাসীপর্ব
পরবর্তী নিবন্ধটিসিবির পণ্য মজুদ ব্যবসায়ীর ২৫ দিনের জেল