আখতারুজ্জামানের সঙ্গে আনারের দ্বন্দ্ব কোন ব্যবসা নিয়ে?

| রবিবার , ২৬ মে, ২০২৪ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

ঝিনাইদহ৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ‘হোতা’ আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ। আখতারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দেশে তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। অন্যদিকে খুন হওয়া সংসদ সদস্য আনারের দৃশ্যমান ব্যবসা হলো ভারত থেকে মোটর পার্টস আমদানি এবং মুদি পণ্যের কেনাবেচা। গণমাধ্যমে অজ্ঞাত সূত্রের বরাত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের কথা বলা হলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছে না পুলিশ। আবার কিসের ব্যবসা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, তা নিয়েও কোনো ধারণা দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি রিমান্ড আবেদনেও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। যদিও খুন হওয়ার আগেপরে কী কী ঘটেছে তার উল্লেখ আছে।

আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ দাবি করেছেন, তার জানা মতে, আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সংসদ সদস্য কোনো ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। আনার সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, সেগুলোকে রাজনৈতিক মামলা বলছে তার পরিবার। মামলা সব মিলিয়ে ছিল ২১টি। গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্রের হলফনামায় বলা আছে এসব মামলা থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, সন্দেহভাজন খুনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গেও আনারের দ্বন্দ্ব ছিল রাজনৈতিক। সেই ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক এই দুই দ্বন্দ্বের জেরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে গ্রেপ্তার তিনজনের রিমান্ড আবেদনে লিখেছে পুলিশ।

গণমাধ্যমে যেসব তথ্য : আনার হত্যার শিকার হয়েছেন বলে কলকাতা পুলিশ জানানোর পর থেকে স্থানীয় সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই হত্যায় পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন আখতারুজ্জামান শাহীন স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। বলা হচ্ছে, আখতারুজ্জামান দুবাই থেকে স্বর্ণ আনতেন। সেগুলো ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের ব্যবস্থা করতেন সংসদ সদস্য আনার। সেসব স্বর্ণ ভারতে পাচারের বিনিময়ে আনার কমিশন পেতেন। চোরাকারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেকের সঙ্গেই তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে এসব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এক সময় ফুটবল খেলে নাম করেছিলেন আনার। নব্বই দশকে ভারত থেকে ভিসিআর আমদানির ব্যবসা করতেন। তার বিরুদ্ধে চোরাচালান, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি দীর্ঘদিন পালিয়ে ভারতে গিয়ে অবস্থান করেন।

তবে এসব বিষয়ে প্রশ্নে পুলিশের কর্মকর্তারা এখন কথা বলতে চাইছেন না। এমনকি কথা যে বলতে চান না, তা জানাতেও অনীহা দেখিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে আনারকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করে পুলিশ সদরদপ্তর। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার আশীর্বাদ পেয়ে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, তখন থেকেই ওই সীমান্ত এলাকার অন্যতম নিয়ন্ত্রক বনে যান আনার। এরপর ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হন।

তবে তার মেয়ে মুমতারীন ফেরদৌস ডরিন দাবি করেছেন, ওগুলো রাজনৈতিক মামলা ছিল। এসব প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা এখন বলছেন, কলকাতায় চোরাকারবারিতো আমি সাংবাদিকদের বলি, তিন তিনবার জাতীয় সংসদে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। তখন আপনারা কি এ তথ্যটা এনেছিলেন? এখন ভারতীয় সাংবাদিকরা কোন তথ্য আনল, সেটার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন কেন? আপনারা তো এ দেশের নাগরিক। সে (আনার) যদি অপরাধী হয়, তাহলে সে কথা আপনাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কেন আসল না? এটা আমারও প্রশ্ন।

তবে আখতারুজ্জামান ও আনারের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, তারা দুজনে বাল্যবন্ধু। কলকাতার পুলিশ জানিয়েছে, নিউটাউনের বিলাসবহুল যে ফ্ল্যাটটিতে এমপি আনারকে হত্যা করা হয় সেটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান। ঝিনাইদহে আখতারুজ্জামানের বিলাসবহুল বাগানবাড়ি রয়েছে। মাঝেমধ্যে বন্ধুর সেই বাগানবাড়িতেও যেতেন আনার।

আদালতকে যা জানিয়েছে পুলিশ : আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে থানায় হওয়া মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শুক্রবার আদালতে পাঠায় পুলিশ। তারা হলেন আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া, তানভীর ভুঁইয়া ও সেলেস্টি রহমান। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত।

আদালতের কাছে রিমান্ড আবেদনে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান লিখেছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হত্যার শিকার আনোয়ারুল আজীম আনারের সঙ্গে ঘটনার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আখতারুজ্জামান শাহীনের দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। সেই ব্যবসার ধরন নিয়ে কোনো কিছু খোলাসা না করে আবেদনে আরও লেখা হয়, ব্যবসায়িক লেনদেনসহ কিছু বিষয় নিয়ে এমপি আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল শাহীনের, যা জানতেন না এমপি আনার। আর হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে মূল সমন্বয়কারী আমানুল্লা ওরফে শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে এমপি আনারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ছিল। তাই এই দুজন মিলে পরিকল্পিতভাবে এমপি আনারকে দেশের বাইরে ভারতের কলকাতায় নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যেন কেউ বুঝতে না পারে।

ওই আবেদনে পুলিশ কর্মকর্তা লেখেন, আখতারুজ্জামান গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের সঙ্গে নিয়ে ৩০ এপ্রিল ভারতের কলকাতা গিয়ে নিউ টাউন এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করেন এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে থাকা অবস্থায় এমপি আনারকে ব্যবসায়িক বৈঠক করার কথা বলে কলকাতায় যেতে বলেন আখতারুজ্জামান।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন আখতারুজ্জামান যা জানতেন না এমপি আনার। দেশে আসার আগে আমানুল্লাকে দায়িত্ব দিয়ে বলে আসেন, কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয় এবং কোনো প্রমাণ না থাকে। ১২ মে আনার কলকাতায় গিয়ে এক বন্ধুর বাসায় উঠেন। পরদিন বৈঠক করার জন্য আখতারুজ্জামান শাহীনের নিউটাউনের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা এমপি আনারকে হত্যা করে হাড়মাংস আলাদা করে গুম করে ফেলে যেন কোনো প্রমাণ না থাকে।

আনারের ব্যক্তিগত সহকারী কী বলছেন : আনোয়ারুল আজীম আনারের সঙ্গে আখতারুজ্জামান শাহীনের কোনো অংশীদারত্বের ব্যবসা নেই বলে দাবি করেছেন খুন হওয়া সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ। তিনি আনারের দীর্ঘদিনের সহচর। শুক্রবার রাতে রউফ বলেন, আমার জানামতে এমপি সাহেবের সঙ্গে আখতারুজ্জামান শাহীনের কোনো ব্যবসা নেই।

আনার কী ব্যবসা করতেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এলাকায় তার ভূষিমালের দোকান আছে। এছাড়া তার আমদানিরপ্তানির ব্যবসা আছে। তার প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে মোটরসাইকেলের পার্টস আমদানি করে দেশে বিক্রি করে থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅব্যাহতি পেয়ে বিএনপি নেতার পোস্ট ‘আন্তরিক ধন্যবাদ’
পরবর্তী নিবন্ধসেদিন হত্যার পরিকল্পনা ছিল না মৃত্যু ক্লোরোফরমের প্রভাবে