আইনে নিখোঁজ বা লাপাত্তা ব্যক্তি কে?

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | শুক্রবার , ৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে ‘গুম’ বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কম নয়। লাপাত্তা, নিখোঁজ, Missing ,Empty,Disappear, অনুপস্থিত প্রভৃতি শব্দ নিয়ে আইনের নানাবিধ ব্যাখ্যা আছে। আজ আমরা এখানে আলোচনা করবো প্রচলিত ভাষায় ‘লাপাত্তা’ বা ‘নিখোঁজ ব্যক্তি’ কে তা নিয়ে। দীর্ঘদিন যদি কোনো ব্যক্তির খোঁজ না মেলে, অর্থাৎ ওই ব্যক্তি মৃত নাকি জীবিত তা না জানা যায় তবে এমন ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। নিখোঁজ ব্যক্তির সম্পদের কেউ উত্তরাধিকার দাবি করলে তাকে সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রমাণ করতে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাত বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ আছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ব্যক্তির নিখোঁজের সময়সীমা সাত বছর অতিবাহিত হলেই কেবল সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী ধরে নিতে হবে তিনি মৃত। সে ক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকারীরা সম্পদের অধিকারী হতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় উত্তরাধিকারীদের সম্পদ হস্তান্তরে আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী যেসব কারণে স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। তার মধ্যে অন্যতম হল, যদি চার বছর যাবৎ স্বামী নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ থাকলে স্ত্রী স্বামীকে তালাকের আবেদন করতে পারেন। যখন কোনো ব্যক্তি জীবিত আছে নাকী মারা গেছে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন আসে সেক্ষেত্রে প্রমাণের দায়ভার (Burden of Proof) কার তা সাক্ষ্য আইনের ১০৭ ও ১০৮ ধারায় উল্লেখ আছে। ১০৭ ধারায় কোনো ব্যক্তি জীবিত না মৃত এবং তা দেখার জন্য বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে সেই ব্যক্তি জীবিত ছিল কিনা? তখন যে ব্যক্তি তাকে মৃত মর্মে দাবী করে, তা প্রমাণের দায়িত্ব সে ব্যক্তির উপর ন্যাস্ত থাকে। ১০৮ ধারায় বলা হয়েছে, ৭ বছর ধরে কোনো ব্যক্তির হাদিস পাওয়া না যায় এবং যদি উনি বেঁচে থাকতেন সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে যাদের সাথে উক্ত ৭ বছরে যোগাযোগ হত তাদের সাথে যদি কোনো যোগাযোগ না হয় সেক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাকে জীবিত বলে দাবী করে তার উপর প্রমাণের দায়ভার (Burden of Proof) বর্তায়। জীবন ও মৃত্যুর অনুমান সম্পর্কে মুসলিম আইনে বলা হয়েছে, কোন লোক ‘লাপাত্তা’ হলে তার জন্ম তারিখ হতে গননা শুরু করে ৯৯ বৎসর-যাবৎ সে জীবিত ছিল বলে ধরা হয়। হিন্দু আইনের বিধান মতে কোন লোককে মৃত বলে ধরতে হলে তার নিখোঁজ হওয়ার তারিখ হতে ১২ বৎসর সময় অতিবাহিত হতে হবে। মুসলিম আইনে কোনো লোক সম্পর্কে ৯৯ বৎসর যাবৎ কোনো খোঁজ খবর পাওয়া না গেলে তাকে মৃত অনুমান করে উত্তরাধিকার সূত্রে তার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকানা বিবেচনা কালে তাকে নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে মৃত বলে ধরা হয়। কিন্তু প্রচলিত সাক্ষ্য আইন, মুসলিম ও হিন্দু আইনের উপরোক্ত অভিমত অনুমোদন করে না। কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হলে সাধারণ নিয়ম হলো তার উত্তরাধিকারীদের থানায় জিডি করতে হবে। তবে কেউ যদি জিডি না করে, তবে উত্তরাধিকারী হিসেবে ওই ব্যক্তির সম্পদের মালিকানা দাবি করলে তাকে সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রমাণ করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাত বছরের বেশি নিখোঁজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের একটি রায় প্রণিধানযোগ্য। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) কাছ থেকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটের একটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন মো. ইসমাইল নামের এক ব্যক্তি। ‘ক্যালকাটা গান (বন্দুক) রিপেয়ারিং ওয়ার্কস’ নামের ওই দোকানে বন্দুক মেরামত করা হতো। ইসমাইল হোসেন দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে দোকানের মালিকানা দাবি করে ইফাতে আবেদন করেন খায়রুন নেসা। তিনি আবেদনে নিজেকে ইসমাইলের ভাগ্নি এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী দাবি করেন। কিন্তু ইফা তাঁকে ওই দোকানের মালিকানা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকার নিম্ন আদালতে মামলা করেন। ওই আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর তিনি ওই রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে আপিল (প্রথম আপীল ৩৬৬/৯৫) করেন। এই মামলায় শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালের ২০ মে রায় দেন। ওই রায় খায়রুন নেসার পক্ষে যায়। ওই রায় অনুযায়ী দোকানের মালিকানা পান তিনি। সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। এই বিশ্বে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পিপল বলছে, এসব ঘটনার বেশির ভাগের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র; বিশেষ করে মাদক পাচারকারীরা। এ ছাড়া বন্য প্রাণী চোরাচালান, মানব পাচার, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি এমন আরও অনেক অপরাধী চক্র মানুষের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। যেসব গুমের সঙ্গে কোনোভাবে রাষ্ট্র জড়িত; যেখানে একজন মানুষকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে, গোপনে আটকে রেখেছে অথবা মেরে ফেলেছে এবং লাশটাকে লুকিয়ে ফেলেছে তাদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এই অপরাধের ধরন অনেক রকম হতে পারে: একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, একসঙ্গে অনেক মানুষের গুম হয়ে যাওয়া, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে পরস্পর সংযুক্ত একাধিক ঘটনা। পারিবারিক নির্যাতন, মানসিক কারণে বা পাওনাদারের পাওনা না দিতেও অনেকে অনির্দিষ্টকাল আত্মগোপন করে থাকতে পারে। এমন ঘটনাও কম নয়। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ পাচার, চিরতরে ফিরে না আসার ঘটনাও চোখে পড়ে। অনেকে আবার নিখোঁজ হন নিজের ইচ্ছাতেও। পাচারের শিকার হয়েও অনেকের নাম নিখোঁজের তালিকায় উঠে আসে। মুক্তিপণ দাবী, অপহরণ ও গুম এর ক্ষেত্রে জিডি এজাহার ইত্যাদি আইনী পদক্ষেপ থাকতে হয়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অন্যথায় নানা আইনি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। নিখোঁজ বা লাপাত্তা ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবীতে আদালতে ঘোষণামূলক মামলা করে একাধিক উত্তরাধিকারী থাকলে সকলকে মামলায় বিবাদী বা মোকাবিলা বিবাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত করতে হবে। একাধিক বাদীও থাকতে পারে। এরপর আদালত থেকে নিজেদের দাবির পক্ষে রায় পাওয়া গেলেই কেবল নিখোঁজ ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের মালিকানা দাবী করা যাবে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ ও খুঁজে বের করতে বিজ্ঞান ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। কেউ যেন এ ধরণের অপরাধের শিকার না হয় তজ্জন্যে সমাজ ব্যবস্থা আরো জোরদার হতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটা স্যামসাং মোবাইল ও ডেবিট কার্ডের গল্প
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা