আইনজীবী এ.কে.এম.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্মরণে

মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী বাবু | বৃহস্পতিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এ.কে.এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একটি আলোকবর্তিকার মতো ও অবিস্মরণীয় একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। অতি অল্পদিনে চলে গেলেন আমাদের আইনজীবী সমাজের গর্বের মানুষ বিশাল হৃদয়ের এই মহাপ্রাণ মানুষটি। স্যারকে নিয়ে কিছু লেখার দুঃসাহস আমার কোনোদিন হয়ে উঠেনি। আজ অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আন্তরিক শ্রদ্ধাভরে আমার চাচা শ্বশুর এই বরেণ্য আইনজীবীকে স্মরণ করছি। আমার চাচা শ্বশুর এ.কে.এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, দেশ বরেণ্য সিনিয়র আইনজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম বারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বারের অনেক বিশিষ্ট গুণী আইনযোদ্ধা বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছ থেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আইনজীবী পরিবারের তেমনি একজন সূর্যসন্তান ছিলেন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, সাবেক চট্টগ্রাম জেলা পিপি (জীবনের শেষ অবধি পর্যন্ত) বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এ.কে.এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যাঁকে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্নেহের সিরাজ’ বলে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম ১৫ আসন (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) হতে নৌকার প্রতীক নিয়ে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য নির্বাচন করার মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ নীতি নির্ধারণী স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন। এই বরেণ্য আইনজীবী আদালত পাড়ায় সর্বজন গুণীজন ও বিচারাঙ্গণে একজন আইনী অভিভাবক সহ আইন অঙ্গনের বটবৃক্ষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি ছিলেন। শুধু তাই নয় পটিয়া আইন কলেজের অধ্যাপক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্যারের আপন মেজ ভাই আমার শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান চৌধুরীর উৎসাহ উদ্দীপণা, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় তিনি আইন অঙ্গনে পদার্পণ করেন। শুরু করেন আইন বিষয়ে পড়াশুনা। সেই যাত্রা থেকে শুরু করে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আইনজীবী পরিবারের কর্ণধার এই মহাপুরুষের জন্ম হয় ১৯৫৫ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হায়দার আলী সিকদার বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। শৈশবেই তিনি বাবা মরহুম মকবুল আহমেদ ও মাতা মরহুমা মায়মুনা খাতুন কে হারিয়েছিলেন। স্যারের শৈশব কাটে তাঁর সুজলা সুফলা প্রকৃতির আচ্ছন্ন ঘেরা নিজ গ্রামে। জমিদার পরিবারের সন্তান এই বরেণ্য আইনজীবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শেষ করে আইনের বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম আইন কলেজ হতে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং একজন আইনজীবী হিসেবেই তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। এভাবে আইনী পেশায় তিনি প্রায় সুদীর্ঘ ৪২ বছর অতিবাহিত করেন। ধীরে ধীরে আইন জগতের এই অভিভাবকের আইনপেশায় সফলতা আসতে থাকে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও বেশ সুনাম অর্জন করেন। ছাত্র জীবন হতেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন এবং ছাত্র অবস্থায় অসংখ্য নাটক ও উপন্যাস লিখেছিলেন। তাঁর স্বরচিত বিভিন্ন নাটকে নির্দেশনা, অভিনয়ও করেছেন। মানব সেবায় তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। এই বিশিষ্ট আইনজীবী মেধায়, মননে, দক্ষতায়, অত্যন্ত জ্ঞানী, নিরহংকারী ও সহজ সরল ব্যক্তি হিসেবে অতি অল্প সময়েই সকলের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। অল্প সময়েই তিনি আদালত পাড়ায় অবিসংবাদিত আইনজীবী নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন সুবক্তা হিসেবেও ভক্তদের কাছ থেকে প্রচুর সুনাম অর্জন করে নিয়েছিলেন ইতোমধ্যে। খুব অল্প কথায় তাঁর বক্তব্যের প্রধান প্রধান বিষয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিকই বাদ না দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতেন। স্যারের মৃত্যুর পর তাঁর একজন অন্ধ ভক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি কিন্তু উকিল সিরাজকে দেখেছি’। এছাড়াও স্যারের একজন শিষ্য চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী রফিকুল হাসান সাহেব লিখেছেন- ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথারিয়া, কোথাও তুমি নেই, লুসাই থেকে কর্ণফুলী, সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্তে, তোমাকে মনে পড়বেই। এইভাবে কবিতা লিখে স্যারের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির যেকোন দুর্দিনে, সংকটময় মুহূর্তে তিনি পাশে থেকেছেন। আইন অঙ্গণে দেওয়ানী, ফৌজদারী ও রাজস্ব আইনে পারদর্শী ছিলেন। যেকোনো মুহূর্তে আইনগত যে কোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান দিতে পারতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও স্যার প্রতি সপ্তাহে নিজ গ্রামে ছুটে যেতেন। গ্রামবাসীদের সুখে দুঃখে, ভালমন্দে, বিপদে আপদে সব সময় তাদের পাশে থাকতেন। আত্নীয়, অনাত্নীয়, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে মুল্যায়ন করেছেন স্রষ্টার সৃষ্টি সেরা মানব হিসেবে। তিনি এলাকায় বিভিন্ন স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, সামাজিক সংগঠনের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ বরেণ্য আইনজীবী ও একজন প্রতিভাবান মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সবার সাথে তিনি সহজ সরল মনোভাব পোষণ করতেন। সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষের প্রতি ছিলেন কোমল ও সহানুভুতিশীল। স্যারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে পড়ে ২০২১ সালের চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বারের অডিটোরিয়ামে এই অনলবর্ষী বক্তা সিরাজ স্যারের সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যটি ‘হিমালয়ের সাথে যেমন সিআরবি পাহাড়ের তুলনা হয় না, তেমনি সমন্বয়ের সাথে ঐক্য পরিষদের তুলনা হয় না’। স্যারের তুলনা স্যার নিজেই। অন্য কারো সাথে এই মহান ব্যক্তির তুলনা চলে না। ‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত’ জন্মিলে মরিতে হইবে। প্রকৃতির নিয়মের কাছে হার মেনে অবশেষে এই দেশ বরেণ্য আইনজীবী সবাইকে কাঁদিয়ে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন রোজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামস্থ পার্কভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৬৭ বছর বয়সী এই স্যারকে তাঁর নিজ জন্মভুমি লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হায়দার আলী সিকদার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আইনী পরিবারের সন্তান এই মহান ব্যক্তির শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়। আত্নীয়, অনাত্নীয়, দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, আইনজীবীগণ, সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সচিব, মেয়র, সাংবাদিক, সাধারণ জনগণ, পাড়া প্রতিবেশী তথা চট্টগ্রাম এর সর্বস্তরের জনগণ ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন। এখনও তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করেন এবং তাঁর কবর জিয়ারত করেন। এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার পিপি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও নানান গুণে গুণান্বিত অ্যাডভোকেট এ.কে.এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উজ্জ্বল ও অসাধারণ কর্মজীবন তাকে তাঁর সময়ে একটি জীবন্ত কিংবদন্তী এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্মরণীয় নাম হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন আজীবন। অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়ে আছেন, থাকবেন। কালের বিবর্তনে যাতে স্যারের স্মৃতি বিলীন হয়ে না যায়, আইনজীবী পরিবারের এই মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের নিকট তাঁর জন্মস্থান লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামে একটি সড়ক নামকরণ এবং চট্টগ্রাম বারের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (ফোকাল পয়েন্টে) একটি স্মৃতিফলক নামকরণের জন্য চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নিকট দাবী ও বিনীত অনুরোধ জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ স্যারকে বেহেস্তের উঁচু মাকামে নসীব করুক।
লেখক : আইনজীবী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে মুদির দোকানে টিসিবি পণ্য বিক্রি, জরিমানা