‘ও-ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান ও-ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দইজ্জার কূলত বসত গরি শিনাদি ঠেগাই ঝড় তুয়ান’
মেজ্জান, বলীখেলা, সাম্পান, শুঁটকি, বেলা বিস্কুট, লবণের কথা উঠলে কোনো কথা নেই আঁরা চাটগাঁইয়া। এই শব্দগুলো এখন শুধু ঐতিহ্য বহন করে না চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস লোকজ সংস্কৃতির অংশও বটে। কথায় আছে ‘নুন খায় যার গুণ গায় তার’। খনার বচন আছে ‘নারিকেল গাছে নুনে মাটি, শীঘ্র শীঘ্র বাঁধে গুটি- অর্থাৎ নারকেল গাছের গোড়ায় নোনা মাটি দিলে দ্রুত ফল আসে। লবণ শিল্প এলাকার আশপাশে নারিকেল গাছের ফলন ভালো হয় সেটা প্রবাল দ্বীপে প্রমাণ মিলে নারিকেল জিঞ্জিরা কিংবা সমুদ্র বা নদীর পারে লবণাক্ত থাকলে নারকেল ভালো ফলে। নুন আন্তে পান্তা ফুরায়। কেউ কারও কাছ থেকে উপকার পেয়ে কিংবা ভালো খাবার বা নিমক খেয়ে যদি হঠাৎ করে অকৃতজ্ঞের মতো কাজ করে কিংবা ভুলে যায় লোকে বলে নিমকহারাম। লবণ নিয়ে খোঁচা মারা বা খোঁটা প্রচলিত আছে। পৃথিবীতে লবণের সন্ধান কিংবা লবণের উৎপত্তি কীভাবে হলো জানা যাক-
লবণ শিল্পের ইতিকথা:
লবণ বা নুন কীভাবে এলো, কোথা থেকে এলো সত্যি বিষ্ময়কর। লবণের ইংরেজি নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। একটি রাসায়নিক পদার্থ যা লবণ বা সল্ট নামে পরিচিত। যার রাসায়নিক সংকেত হলো- NACL. সেলারি এবং খ্রিষ্টাব্দজার এবং খ্রিষ্টাব্দা শব্দটি তিনটি সল্ট শব্দ থেকে। আদিকালে রোমে এবং গ্রিসে সৈন্যদের বেতন দেওয়া হতো লবণ দিয়ে শুধু তাই নয় গ্রিকরা দাসদাসী কেনাবেচা করার সময় লবণকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত। বিজ্ঞানীরা জানান, লবণ উৎপত্তি ইতিহাস খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে। চীনের লোকেরা মাটি খনন করে গভীর খাদ থেকে লবণ সংগ্রহ করত। চীনের সানশি প্রদেশের ইয়নচুনে এক লবণের খনি পাওয়ার কথা জানা যায় এটাই সবচেয়ে প্রাচীন লবণের খনি যে খনি থেকে মানুষ মাটি খুঁড়ে লবণ উত্তোলন করত। এছাড়াও পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়াসহ আরও কিছু দেশে লবণের খনির দেখা মিলে। অস্ট্রিয়ার খ্রিষ্টাব্দজবুর্গ নামে একটা জায়গা আছে যার মানে হলো লবণের শহর। সে সময় থেকে লবণের ব্যবহার শুরু হয়। আদিম যুগের মানুষেরা বন্য প্রাণীর মাংস সংরক্ষণ করার জন্য লবণের ব্যবহার করত। মিশরে মমি সংরক্ষণ করতে লবণ ব্যবহার করা হয়। লবণ নিয়ে একটা আন্দোলন হয়েছিল একে লবণ আইন অভিযান বলা হয়। অনেকে সল্ট মার্চও বলে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই লবণ আন্দোলনের বিশেষ মর্যাদা ছিল।
লং মার্চের আহ্বায়ক ছিলেন- মহাত্মা গান্ধি। ব্রিটিশ সরকার যে কর আরোপ করেছিলেন তার প্রতিবাদে লং মার্চ। সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ মহাত্ম্না গান্ধির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। লবণের জন্য মূলত লংমার্চটি হয়। জাপানে লবণকে খুব পবিত্র হিসেবে জানে। জাপানের শিন্টোরায় কোনো স্থানকে বা মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে লবণ ছিটানো হতো। সুমো কুস্তিগিরদির উপর লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ইতালির ভেনিস শহরের সাথে জেনোয়া নামের শহরের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল লবণকে কেন্দ্র করে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের একটি জায়গায় লবণের সন্ধান পাওয়া গেলে সেই শহরে লিভারপুল নামে এক বিশাল বন্দর গড়ে ওঠে।
আমাদের দেশের লবণের ইতিকথা জানা যাক- বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার বলা হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে। দরিয়া নগর বেষ্টিত কক্সবাজারে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল হিরাম কক্স নামে যার নামকরণ হয় ‘কক্সবাজার’। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মূলত লবণ শিল্পের যাত্রা শুরু। চট্টগ্রামে আদিকালে ‘মুলঙ্গী’ শ্রেণি নামে কিছু লোক বসবাস করত। তারা সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে বলা হতো তোফল। মোগল আমলে নিমক জায়গির মহাল ও নিমক এয়জ মহাল নামক দুটি বিভাগ লবণ শিল্প নিয়ন্ত্রণ করত। ১৭৫৭ এবং ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইংরেজরা বেনিয়াদের মাধ্যমে লবণ ব্যবসা শুরু করে। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বণিক সমিতি গঠিত হলে ইস্ট ইন্ডিয়ার কর্মকর্তারা লাভবান হলে পরবর্তীতে ওয়ারেন হেস্টিংস লবণ শিল্পের ওপর সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য শুরু হয়। লবণ চাষের জন্য সর্বোচ্চ লবণ চাষীকে পাঁচ বছরে জন্য জমি ইজারা দিত। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রথা বিলুপ্ত করে নতুন পদ্ধতি চালু হয়। এই পদ্ধতি ১৭৮০ পর্যন্ত চালু থাকে। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির আধিপত্য চলতে থাকে। উক্ত কোম্পানি কর্তৃক আরোপিত কর প্রশাসন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি এবং ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ কোম্পানি তাদের শাসনের সময় চট্টগ্রামে তাদের কর্মচারীদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইপসিক বা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় যা বর্তমানে বাংলাদেশ কুটির শিল্প কর্পোরেশন বা বিসিক নিয়মিত তাদের কর্মচারী দ্বারা ১৯৬০-৬১ খ্রিষ্টাব্দে লবণ শিল্পসংক্রান্ত কার্যক্রম আরম্ভ করে।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজারে জেলায় লবণ চাষ শুরু হয়। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ কোম্পানি যখন লবণ উৎপাদনে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হতে থাকে তখন অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সমুদ্র উপকূলীয় জমি পরিষ্কার করে সাগরের পানি সূযের্র তাপে বাষ্পিত করে লবণ চাষ শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজারের গোমাতলীতে এক ব্যক্তি ১২০ একর জমিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে লবণ চাষ করেন। সেই থেকে সমগ্র বাংলাদেশে লবণ উৎপাদনের সূচনা। সে সময় থেকে লবণ শিল্প ব্যাপকভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগে সাড়া ফেলে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পটিয়া চানখালী খালের পাড়ে লবণ শিল্পের সূচনা হয়। তখনকার দিনে ঐ এলাকায় কোনো লবণ শিল্প কারখানা ছিল না। সে সময় সাম্পান বা বোটে করে বাঁশখালী এলাকা থেকে কালো লবণ এনে ইন্দ্রপুলে বিক্রি করা হতো। প্রথম দিকে এ শিল্পের সূচনা করেন হাজী চুন্নু মিয়া, পরবর্তীতে চুন্নু মিয়ার পুত্র তোফায়েল আহমেদ সওদাগর প্রকাশ জলাইয়ার বাপ, লবণ শিল্পের ব্যাপকতা বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সে সময় লবণের মিল কারখানা ছিল না। জাঁতাকল এবং চাক্তির চালিত কলের মাধ্যমে লবণ চাষীদের কাছ থেকে কাদামিশ্রিত কালো বর্ণের লবণ সংগ্রহ করা হতো। পরবর্তীতে তা জাঁতাকলের মাধ্যমে শোধন করে পরিষ্কার করে বাজারে সের ব মণ ধরে বিক্রি করা হতো।
পরবর্তীতে গাজী আব্দদুল কাদের সওদাগর, আবদুর রহমান সওদাগর, মফিজুর রহমান সওদাগর, হাজি জামিল সওদাগর, নজু মিয়া, ফজর রহমান, আফাজুর রহমান, আবদুল খালেক, আবদুস সামাদ, আবদুস সাত্তার, নুরুল হুদা, ইউসুফ, এজাহার মিয়া, মনিন্দ্রলাল, আবদুর রহিম, আবদুল হক আল্লাই, নজির আহমেদ, আলি আহমেদ, আজিজ সওদাগর, মতি সওদাগর, কবির আহমেদ, গাজী আবদুল কাদের, গাজী আবদুল হক, মুন্সেফ আলী ও আবুল খায়ের প্রমুখ। এদের মধ্যে সবাই না ফেরার দেশে, পরবর্তীতে হাল ধরেছে ওঁদের পরবর্তী প্রজন্মরা। ঢাকা খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার অনেক বড়ো বড়ো ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাও এখানে এসে বিনিয়োগ করেছে। অনেকে ট্রাকে করে লবণ ক্রয় করে নিয়ে যায়। লবণ শিল্পের পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে চট শিল্প, সুতা, পলিব্যাগ, রাইসমিল, তুষ ও কালো কাঠের মিল, সেমাই ও ময়দা কারখানা। একসময় ৫০-রর বেশি লবণের মিল ছিল। বর্তমানে ৪০-৪২টিরও বেশি লবণ শিল্প কারখানা রয়েছে। কক্সবাজার, চকোরিয়া, বাঁশখালী, মগনামা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া থেকে কালো লবণ এনে রিফাইনারির মাধ্যমে সাদা করা হয়। পরে সে লবণে আয়োডিন মিশ্রিত করে পলি প্যাকের মাধ্যমে বাজারজাতকরণ করা হয়। ইন্দ্রপুল লবণ শিল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে লবণের মাঠও রয়েছে। লবণের পানি আটকিয়ে রাখা হয়। খর রোদ পড়লে দেখা যায় আটকিয়ে রাখা লবণের পানিগুলো শুকিয়ে লবণ উৎপাদিত হয়ে যায়। সমগ্র বাংলাদেশে চট্টগ্রামের লবণের একটা নাম যশ রয়েছে।
লবণ উৎপাদন বা চাষাবাদের উর্বর জায়গা: নাজিমপুর, জুলদিয়া, বাহারছরা এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামপুর, মহেশখালী, চকোরিয়া পেকুয়া, কুতুবদিয়া, কুতুবখালী, ইসলামাবাদ, ফুকখালী, বাড়বুখালী, চপুলণ্ডী, টেকনাফ, মগনামা, চট্টগ্রাম মাঝিরঘাট টেকনাফ, বাঁশখালী, পটিয়া ইন্দ্রপুল, বোয়ালখালী ছাড়া আরো বিভিন্ন জায়গায় লবণের চাষাবাদ ও কারবার হয়ে থাকে। এছাড়াও পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, নোয়াখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপ আরও বেশকিছু সমুদ্র উপকূলবর্তী জায়গায় লবণ চাষ করার পরিকল্পনা চলছে।
কীভাবে লবণ উৎপাদন বা লবণের চাষ করা হয়: লবণ চাষের উপযুক্ত সময় হলো ফাল্গুন-চৈত্র মাস। বছরে ৬ মাস লবণ চাষ হয়। সমতল ভূমিতে মাটির ছোটো ছোটো আইল করে প্লট তৈরি করা হয় এবং প্লটগুলো রোদে শুকিয়ে গেলে পলিথিন বিছিয়ে দেওয়া হয়। এরপর নদী থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে লোনা পানি আইল যুক্ত প্লটে নোনা পানি আটকে রাখা হয়। চার থেকে পাঁচ দিন রোদে লোনা পানি শুকিয়ে লবণ আস্তরণ পড়ে যায়। আবার অনেকে পলিথিন না দিয়ে কাদাযুক্ত কালো লবণ চাষ করে। কালো লবণগুলো লবণ কারখানায় রিফাইন করে পরিষ্কার করা হয়। ঝরঝরে হলে লবণ রিফাইন করে বস্তা ভরতি করা হয়। অনেকে লবণের মাঠে গভীর গর্ত খুড়ে তাঁর মধ্যে লবণ সংরক্ষণ করে থাকেন। লবণের মাঠ থেকে চাষীদের কাছ থেকে বড়ো বড়ো লবণ ব্যবসায়ীরা লবণ ক্রয় করে এনে রিফাইন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেন।
লবণ নিয়ে যত গল্প : লবণ নিয়ে আছে রূপকথার গল্প, এক দেশে ছিল এক রাজা তাঁর ছোটো মেয়েটি রাজাকে লবণের মতো ভালোবাসত। রাজা একদা সেই কথাটি শুনে রাগান্বিত হলেন এবং রাজ্য থেকে তার ছোটো মেয়েকে বিতাড়িত করেন। অনেকদিন পর রাজা বনে গেলেন শিকার করতে, সেদিন রাজার প্রচণ্ড খিদা পেল। গভীর বনের মধ্যে হঠাৎ তাঁর ছোটো মেয়ের সাথে দেখা। বিতাড়িত হওয়া রাজার মেয়ে তাঁর ক্ষুধার্ত বাবাকে লবণ দিয়ে হাতে বানানো নাশতা খেতে দিলেন। নাশতা খেয়ে রাজা খুশি হয়ে তার কন্যাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং পুনরায় রাজকন্যা তাঁর বাবার সাথে রাজ্য ফিরে গেলেন। আলী বাবা চোরের গল্প সবাই জানেন, চল্লিশ ডাকাতের সর্দার যখন কারো বাড়িতে ডাকাতি করতে যেত, তখন সে নাকি ঐ বাড়ির বাড়তি নুন খেতে অস্বীকার করত। কারণ নুন খেলে নাকি সে নিমকহারামি (বিশ্বাসঘাতকতা) করতে পারবে না। এই দেখে আলিবাবার গৃহপরিচারিকা মর্জিনা ধরে ফেলেছিল, যে সে আসলে অতিথি বেশে ডাকাত।
নুনের (লবণ) যত গুণ : বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একজন মানুষের জন্য ৫ গ্রাম লবণ যথেষ্ট। বাঙালিদের জীবনে তিন আঙ্গুলের চিমটি লবণের কি কদর। খাওয়ার স্যালাইন তৈরিতে লবণ জরুরি। লবণ ছাড়া কোনো খাবার স্বাধ হয় না কথায় আছে ‘আঁতে তিতা দাঁতে নুন, উদর ভরো তিন কোণ’ নুন মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড এতে প্রায় ৪০ ভাগ সোডিয়াম এবং ৬০ ভাগ ক্লোরাইড থাকে। ক্লোরাইড আমাদের দাঁতের জন্য উপকারী। আবার ক্লোরাইডের মূল উপাদান ক্লোরিন জীবণুনাশক। সোডিয়াম শরীরের খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। স্নায়ুর কার্যক্রম সচল রাখে মাংসপেশী সংকোচন প্রসারণে ভূমিকা রাখে। শরীরে গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজার মিলিগ্রাম সোডিয়ামের প্রয়োজন। লবণ এমন একটি খাদ্য উপাদান যা অধিকাংশ খাবার তৈরিতে প্রয়োজন হয়। জীবনের জন্য লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। লবণে আছে আয়োডিন, বিপুল পরিমাণে সোডিয়াম যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী ইলেক্ট্রোলাইট। পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম অপরিশোধিত লবণে পাওয়া যায়। শরীরে লবণ বেশি হলেও সমস্যা আবার পরিমাণে কম হলেও বিপজ্জনক। আয়োডিনযুক্ত লবণ শরীরের জন্য খুবই উপকারী। লবণের সাথে সুসম্পর্ক সাবধানতার সাথে করতে হবে। কাঁচা লবণ কিন্তু হার্টের জন্য বিপজ্জনক। খাদ্য তালিকার ছাড়াও ড্রাইং, কাপড় তৈরি, ঔষধ শিল্প, পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্পে প্রচুর পরিমাণে লবণ ব্যবহৃত হয়। বাঙালিদের ভোজনরসদের ম্যানুতে নোনা ইলিশ চাই। কুমড়া বা লাউ পাতা দিয়ে নোনা ইলিশের টুকরো কে শাক দিয়ে ঢেকে ভাজি করে রসনা বিলাস করেন।
লবণ শিল্পের বর্তমান অবস্থা: কক্সবাজার জেলায় ৭০ হাজার একরেরও বেশি জমিতে লবণ উৎপাদন হয়। কক্সবাজার জেলা থেকে ২৩ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি লবণ উৎপাদন হয়। লবণ শিল্প প্রসারে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশে লবণের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও লবণ আমদানির বিষয়টি সত্যি দেশের জন্য আত্মঘাতীও বটে। অনেকটা লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার মতো। গত বছরে ৩ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আমদানির সিদ্ধান্তের বিষয়টি অনেকটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’- লবণচাষী ও ব্যবসায়ীদের কাছে ছিল অনেকটা বিষাদের। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লবণচাষীরা এমনিতে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত লবণ মজুত থাকা সত্ত্বেও ভারত থেকে লবণ আমদানি করার বিষয়টি জেনে শুনে বিষপান করার মতো নয় কি? লবণচাষী আবুল কালাম বলেন, ‘দেশে গত কয়েকবছর ধরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে লবণ আমদানি করছে, আয়োডিন নিয়েও নানা তালবাহানা করে আসছে। এভাবে যদি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হয় আমাদের উৎপাদিত লবণ বাজারে বিক্রি করতে পারব না। লবণের মাঠে কেউ নামবে না। এভাবে যদি চলতে থাকে আগামীতে লবণ শিল্পে ভাটা নেমে আসবে’।
মোহাম্মদী সল্ট লিমিটেডের মালিক লবণ ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ গুণগত মানের লবণ উৎপাদন হচ্ছে সত্যি আগামীতে লবণ শিল্প আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে দেশের উৎপাদিত লবণ বিদেশেও রপ্তানি করার প্রত্যাশা রাখি। তবে সবার আগে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। লবণ শিল্পকে আরও আধুনিক করার জন্য প্রয়োজনে লবণ চাষে এবং লবণ শিল্পকারখানায় আরও উন্নত প্রযুক্তি ও বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা গেলে লবণ উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে এবং পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলবর্তী যারা লবণের চাষ করে তাদেরকে লবণ চাষের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানসহ প্রণোদনা প্রদান করা হলে আগামীতে খাদ্যের মতোই লবণ শিল্পে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে এজন্য লবণ শিল্পের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি’। প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় লবণ। অধিকাংশ খাবার তৈরিতে প্রয়োজন হয় লবণ। বিজ্ঞাপনের ভাষার মতো করে বলতে হয়, ‘লবণ ছাড়া আমাদের চলে না’। আমাদের লবণ শিল্পকে বাঁচাতে হবে। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে লবণ আমদানির জন্য পারমিট বন্ধ করতে হবে। লবণ চাষীরা যাতে তাঁদের ন্যায্য মূল্য পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া রুগ্ন লবণ কারখানাগুলো নতুনভাবে চালু করা যেতে পারে। টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মতো যেসকল জেলা সমুদ্র উপকূলবর্তী আছে বিশেষ করে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, ঝালকাঠি এলাকায়ও লবণ শিল্পের উৎপাদন প্রসারে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লবণচাষীদের প্রশিক্ষণ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে সেমিনার করা যেতে পারে। সরকারিভাবে লবণচাষী এবং লবণ ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রণোদনা দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক হলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় লবণ শিল্প প্রসারে আগামীতে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিভাগ হবে ‘লবণ শিল্পের রোল মডেল।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।