অসহায়ত্ব এবং আশার আলো

পিংকু দাশ | শুক্রবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

আজ নিয়ে ১৬ দিন। গৃহে বন্দী আমি। সারাদিন অলস সময় কাটে। রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের আলোতে বাইরের সবুজ প্রকৃতি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমার যে বাইরে যাওয়া নিষেধ। এরমধ্যে একটা এন্টিবায়োটিক কোর্স শেষ, আরেকটা কোর্সও কাল শেষ হবে। আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কোভিড পেশেন্ট হিসেবে অন্য কোন উপসর্গ না থাকলেও জ্বর এবং দুর্বলতা আমাকে ছাড়ে না।
আগে থেকে নির্ধারিত সময়, বেলা তিনটায় ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন, আপনার ১৭ দিন চলছে, চিন্তার কোন কারণ নেই। উনি আগে কোভিড পেশেন্ট হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাকে দেখলেও ওই দিন উনি স্বাভাবিক পেশেন্ট এর মতই দেখলেন। জ্বর কমার জন্য ডেইলি দুইটা করে হাই এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন পুশ করার পরামর্শ দিলেন। পেটে হাল্কা ব্যথা বলাতে একটা পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফিও করতে দিলেন। আমার হাজবেন্ড আল্ট্রাসনোগ্রাফির জন্য পেইড করে আমাকে স্লিপে লেখামত আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুমে নিয়ে গেলেন। উনারা আমার স্লিপ নিয়ে লাঞ্চ কয়টায় করেছি জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, আপনার আল্ট্রাসনোগ্রাফি সাতটায় হবে। বসে বসে পানি খান। এখানেও বসতে পারেন। আমার বাসা হাসপাতালের একদম কাছেই। কিন্তু গায়ে জ্বর আর দুর্বলতার কারণে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ওখানেই একপাশে বসে বসে পানি খাচ্ছি। আমার হাজবেন্ড বলে, এখনও অনেক দেরী আছে, আমি একটা কাজ সেরে আসি।
ও চলে যাওয়ার পর ওই রুম থেকে বলা হল আপনার আল্ট্রাসনোগ্রাফি হবে পঞ্চম ফ্লোরে। এখানে ম্যাডাম নেই। আমার স্লিপ আর ফাইল দিয়ে দিলেন। আমি ওটা নিয়ে লিফটে না গিয়ে (যেহেতু আমি কোভিড রোগী, যদিও আমার ঘ৯৫, সার্জিক্যাল মাস্ক এবং মুখের নিচ থেকে কপাল পর্যন্ত প্লাস্টিকের একটা কভার, পরলে জোকারের মত লাগে, পরা ছিল) সিঁড়ি দিয়ে নির্ধারিত রুমে পৌঁছলাম। স্লিপ আর ফাইল উনারা জমা নিয়ে আমাকে বললেন, ভুল স্লিপ দেয়া হয়েছে, আপনি কষ্ট করে আসলটা নিয়ে আসেন। হায় হায়, আমি আর পারি না। কিন্তু উপায় নেই। আবার সেকেন্ড ফ্লোরে আগের রুমে আমার ফাইল দেখিয়ে আসল স্লিপ নিয়ে পঞ্চম ফ্লোরে জমা দিলাম। তখন প্রায় ৪ টা বাজে। ৭টায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি হবে। কোণায় বসে বসে পানি খাচ্ছি। সাতটায় গিয়ে বললাম আমাকে ৭টায় আসতে বলেছিলেন। আপনার প্রস্রাবের বেগ আছে? আমি বললাম হ্যাঁ। ১০ মিনিট বসেন। ১০ মিনিট পর আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুমে, পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বেডে শোয়া থেকে শুরু করে যা যা করার, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আল্ট্রাসনোগ্রাফি কেন করছেন? আমি বললাম আমার পেটে হাল্কা ব্যথা আর জ্বর। আপনি কি কোভিড টেস্ট করিয়েছেন? আমি বললাম হ্যাঁ। পজিটিভ নাকি নেগেটিভ? আমি বললাম পজিটিভ। উনি সাথে সাথে ওখান থেকে সরে গিয়ে বললেন, আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছেন? আমিতো কোভিড পেশেন্ট আল্ট্রাসনোগ্রাফি করি না।
আমি বললাম, দেখেন আমার আজ ১৭ দিন হচ্ছে ডাক্তার আমাকে স্বাভাবিক পেশেন্ট এর মতই দেখেছেন। না উনি কোন কথা শুনতে রাজি না। বললেন, আপনি সেকেন্ড ফ্লোরে এ যান। আমি ভাবলাম কোভিড পেশেন্টের আল্ট্রাসনোগ্রাফি হয়তো ওখানে করে। আমি আবার স্লিপ নিয়ে ওই রুমে গেলাম। উনারা আমার স্লিপ নিয়ে ফাইল চাইলেন। হায় হায় আমিতো ফাইল, মোবাইল, মানিব্যাগ সব উপরে ফেলে এসেছি। চোখে তখন অন্ধকার দেখছি, গায়ে জ্বর আবার প্রগ্রাবের চাপ। নিজেকে নিজে গালি দিতে দিতে, হাঁপাতে হাঁপাতে আবার উপর থেকে ফাইল এনে সেকেন্ড ফ্লোরে জমা দিলাম। আমাকে বসিয়ে রাখা হলো। ৮ টার দিকে বলা হলো ম্যাডাম কোভিড পেশেন্ট আল্ট্রাসনোগ্রাফি করবেন না।
একটা মেডিকেল টেস্ট করতে না পারলে মানুষের যে এরকম লাগে তা আমি আগে কখনো চিন্তা করিনি।এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমি ক্রমান্বয়ে কাঁদছি। খালি মনে হচ্ছে এত রাতে আমি এই টেস্ট কোথায় করাবো? কোন কিছু মাথায় আসছে না। তাঁরা বলেছেন, আপনি চাইলে টাকা ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। নিচে গিয়ে আবার স্লিপ জমা দিয়ে টাকা ফেরত নিলাম।
বাসায় আসার পর চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছি না। এত পানি কোথায় ছিল এতদিন! কেন যে হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। লাস্ট কবে কেঁদেছি মনে নেই। কিন্তু এটা কিসের কান্না! মৃত্যু ভয়, অবহেলা, নাকি অন্য কিছু। আমার হাজবেন্ড বলে, এত কান্নাকাটির কি আছে, ওখানে না করলে কাল সকালে অন্য হাসপাতালে করবো। তারপর নিজের মনে নিজেকে বোঝালাম, আমিতো চট্টগ্রাম মেডিকেল এর স্বনামধন্য প্রফেসরের আন্ডারে চিকিৎসা নিতে পেরেছি। ছয়মাস আগে পেশেন্টরাতো সে সুযোগটাও পায় নি। সে তুলনায় আমি অনেক ভাগ্যবান।
যাহোক, এই দুঃসময়ে একমাত্র পরিত্রাণকর্তা আমাদের এই ডাক্তার ভাই বোনেরা। বৈশ্বিক এই সংকটাপন্ন সময়ে তারাই একমাত্র সব ভয়ভীতি অগ্রাহ্য করে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আমার দুঃখ, তাঁরা কোভিড পেশেন্ট করবেন না, সেটা যদি আগে বলে দিতেন তাহলে আমি সময়মত অন্য জায়গায় টেস্টটা করাতে পারতাম। প্রেসক্রিপশানটা একটু দেখলেই বুঝতে পারতেন আমি কোভিড পেশেন্ট, তাঁরা সেটা খেয়াল করেননি। আমাকেও জিজ্ঞেস করলেন না। আমাকে ৩.৩০ থেকে ৮.১৫ পর্যন্ত বসিয়ে রেখে শেষ মুহূর্তে টেস্টটা করলেন না। সেটা একটা কোভিড পেশেন্টের জন্য ভয়াবহ মানসিক চাপ।
১৭ দিনে হয়ে যাওয়াতে ডাক্তার আমাকে স্বাভাবিক পেশেন্টের মতই দেখেছেন। তিনি কি তাহলে তাঁর নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি চিন্তা করেননি?
আশার বাণী হচ্ছে, কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতর এর ডাক্তার, আইইডিসিআর এর ডাক্তার ফোন করে দীর্ঘসময় ধরে কয়েকবার আমার শারীরিক খোঁজখবর নিয়েছেন এবং যেকোন প্রয়োজনে তাঁদের কাছে ফোন দিতে বলেছেন। লোকাল থানার সেকেন্ড অফিসার ফোন করে বোন বলে সম্বোধন করে, যেকোন প্রয়োজনে তাঁকে ফোন দিতে বললেন। এগুলো আমাদের মত কোভিড পেশেন্টদের বেঁচে থাকার বড় রসদ।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা