[খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী, কবি ও গল্পকার সাফায়ত খান আর নেই। তিনি গতকাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন (ইন্না…রাজেউন)। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ইতোপূর্বে তাঁর পাঠানো একটি অপ্রকাশিত গল্প এখানে পত্রস্থ করা হলো।
– সম্পাদক]
গাড়িগুলোর নামগুলো কেমন অদ্ভুত। ‘মদীনার পথে’, ‘বাবার দোয়া’, ‘মায়ের দোয়া’ শহর এলাকার গাড়িগুলোর গন্তব্য অক্সিজেনের মোড় থেকে ফৌজদারহাটের গ্লাক্সো কোম্পানি অব্দি। অথচ নাম দিয়েছে ‘মদীনার পথে’ ‘মক্কার পথে’ একদিন এক মুড়ির টিনকে দেখি গনি বেকারির সামনে ট্রাকের গুঁতো খেয়ে পড়ে আছে। তার গায়ে ফ্লোরেসেন্ট কালারে লেখা ‘রোড টু জান্নাত’। মনে মনে ভাবছিলাম গাড়িটার নাম হওয়া ছিল রোড টু গোরস্থান।
আজ ঢাকা যাচ্ছি। শহরে বড় গাড়ি ঢোকা নিষেধ তাই ছোট গাড়ি করে প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে একটু দূরে বড় গাড়ির কাছে।
যে মিনি মাইক্রো বাসটা নিয়ে যাবে তার গায়ে ছোট করে লিখা ‘বাবার দোয়া’ গাদাগাদি করে বসা যাত্রীদের অলংকারের মোড়ে নিয়ে এসে নামিয়ে দেয়া হলো বড় বাসের দোরগোড়ায়। এক এক করে আমরা সবাই উঠে বসলাম ঢাকাগামী বাসে। নিয়ে আসা ‘বাবার দোয়া’ গাড়িটি একসময় জানালার কাচ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম ভালোয় ভালোয় বাবার দোয়ায় যেন ঢাকা পৌঁছাতে পারি।
চট্টগ্রামে চার রঙের ফ্লিম প্রসেস করার সুযোগ নেই। ক্যালেন্ডারের ফ্লিম প্রসেসের জন্য সবাই ঢাকার নয়া পল্টনে আসে। ফ্লিম প্রসেসের জন্য এম.ও ড্রাইভ জমা দিয়ে চলে গেলাম কাছেই হিমাদ্রীর বাসায়। এই বাসায় আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী হিমাদ্রিসহ চারজন বাস করে। ওরা নয়টার মধ্যে অফিসে চলে যাবে। সেই সময়টা আমি এখানে থাকবো। ইচ্ছে করেই হোটেলে উঠিনি। হোটেলের পরিবেশ অস্বস্থিকর। যেন আমি প্লেজার ট্রিপে এসেছি। নানা আকার ইঙ্গিত দরজায় টোকা বয় বেয়ারার অশ্লীল ইশারায় শান্তিতে ঘুমানো যায় না। মাঝে মধ্যে পুলিশি তল্লাশি রীতিমতো অপমানজনক। এমনিতে রাতের পুরোটাই সজাগ ছিলাম বাসে। ঘুম আসেনা বাসে। দুর্ঘটনার ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি। তার উপর এই জ্বালাতন অসহ্যকর। দিনের বেলায় ঘুমিয়ে আবার রাতের বাস নয়তো ট্রেনে ফিরে যাবো। এ ভাবেই চলছে আমার জীবন। কতদিন চলবে কে জানে।
অফিস শেষে হিমাদ্রি আর তার রুমমেটরা ফিরে এলে আমরা অনেকক্ষণ জম্পেশ  আড্ডা দিই। তারপর আমি আর হিমাদ্রি বেরিয়ে পড়ি।
পল্টন থেকে ফ্লিম নিয়ে দুজন রিকশা করে চলে গেলাম প্রসন্ন পোদ্দার লেনের মুন্নার বাসায়। মুন্না বছর তিনেক চাঁটগায় ছিল। তখনই আমাদের বন্ধুত্ব। বেশ হাসি খুশী ফূর্তিবাজ। যতবারই আসি ততবারই তাঁতিবাজার ঢু মেরে আসা রুটিন হয়ে গেছে। অনেকটা চিমবুক রেস্তোরাঁয়  ঢু মারার মত। 
হিমাদ্রিকে নিয়ে তিনবার মুন্নার বাসায় গিয়েছি। হিমাদ্রিও মুন্নার ভক্ত হয়ে গেছে। ফোনে কথা হলে মুন্নার প্রসঙ্গ টেনে আনে হিমাদ্রি। ও একদিন বলেই ফেললো দোস্ত তোর বন্ধু ভাগ্য বেশ। মুন্নার সাথে কথা বলে মনে হয়নি সে আমার নতুন জানাশোনা। সত্যিই বড় দিলওয়ালা। বাসায় মুন্না একাই ছিল আমাদের অপেক্ষায়। তিনজনের জম্পেশ আড্ডা শেষে আবার বেরিয়ে পড়ি। হিমাদ্রি পল্টনে ফিরে যায়। আমাকে বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে মুন্না চলে যায়।
বাস স্ট্যান্ডটা একটু দূরে। জায়গাটা কেমন নিরিবিলি। তাই লোক সমাগম থাকতেই আমি পৌঁছে যাই। সাবধানের মার নেই। চুরি ছিনতাই খুনোখুনি মহামারীর আকার ধারণ করেছে সারাদেশে। টিকেট কেটে কাউন্টারের সামান্য দূরের হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম। গাড়ি আসতে দেরী হবে।
হোটেলটা বেশ পরিচ্ছন্ন। রান্না ভালোই। বাস ছাড়তে আরো এক ঘণ্টা। হোটেলের গ্রাহক বেশীর ভাগই বাসযাত্রী। ক্যাশ কাউন্টারের সামনের টেবিলেই বসলাম রাস্তার দিকে মুখ করে। খাবারের অর্ডার দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর তরকারি নিয়ে এলো বয়। বেশ কবার এখানে আসাতে ও চিনে রেখেছে আমাকে। খাতির যত্ন করে। দশ বিশ টাকা বখশিশ দিই। মাঝে মধ্যে আমার মালপত্র বেশি হলে এই ছেলেটা বাস অব্দি বয়ে নেয়।
খাচ্ছি আর এদিক ওদিক দেখছি। দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। একি দেখছি? দরজায় দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে হোটেলের এক কর্মচারী। আর বৃদ্ধ ভিক্ষুক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একেবারে চোখাচোখি। দুজনই দুজনার দিকে তাকিয়ে আছি কতক্ষণ জানি না। চিৎকার করে ছেলেটাকে বললাম বৃদ্ধকে ঢুকতে দেয়ার জন্য। আমার প্রচণ্ড জোরে চিৎকার শুনে হোটেলের ভেতর বাহির সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো। বৃদ্ধ খুবই বিনীত হয়ে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমিও তাকে সম্মান জানাতে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু মূহুর্ত। বিস্ময়কর দৃশ্য যেন হোটেলের ভেতরকার মানুষগুলোর কাছে। লোকটার শরীরে যেন আমার সদ্য প্রয়াত বাবার মাথাটা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। হুবহু আমার পিতা যেন আমার মুখোমুখি। চুল দাঁড়ি চোখ মুখ গালের চামড়ার ভাজগুলো আমার কত চেনা। শরীর থেকে শুধু আতর আর আগরের গন্ধ ভেসে আসছে। যতই দেখছি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। চোখ ফেরাতে পারছি না।
বসতে বললাম। উনি বসলেন। বৃদ্ধের জন্য খাবার আনতে বললাম। এরই মধ্যে আমি প্রায় খাওয়া শেষ করার পথে।
খাবার দিয়ে গেল বয়। এক পিস রুই মাছ এক পিস মুরগির মাংস সাথে ডাল ভাত। উনি প্লেটের দিকে মুখ করে খাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত মনে হলো তাকে। মাঝে মধ্যে চোখ তুলে তাকান আমার দিকে সে দৃষ্টির কাছে আমি নতজানু হই আর আমি খুঁজতে থাকি আমার পরম পূজনীয় পিতাকে তার সৌম্য অবয়বের ভেতর।
আমার খাওয়া শেষ দেখে উনি বললেন বাবা আপনি হাত ধুয়ে আসেন কোনো অসুবিধা নেই। আমি একটু ধীরে ধীরে খাই। এ আমার অভ্যাস। কী এক আশ্চর্য মিল আমার সদ্য প্রয়াত পিতার সাথে। তিনিও দীর্ঘ সময় নিয়ে খাওয়া শেষ করতেন। কখনো কখনো ঘণ্টার কাছাকাছি তিনি ডাইনিং টেবিলে কাটিয়ে দিতেন। প্রত্যেকটা ভাত যেন উনি চিবিয়ে চিবিয়ে পিষে খেতেন। বেশির ভাগ সময় তার পাতে  দুধ কলা নয়তো ঘি থাকতো। আম কাঁঠালের মাসে সে সময় আরো দীর্ঘ হতো।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে এগারো। সোয়া এগারোতে গাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা। গাড়ি আছে কি না কে জানে। এসি কোচ। ওরা মনে হয় না অপেক্ষা করবে। বৃদ্ধের খাওয়া এখনো রয়ে গেছে। বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন বাবা দোয়া করি তুমি যেন নিরাপদে তোমার বউ বাচ্চা আর মায়ের কাছে পৌঁছতে পারো। এবার আরো অবাক বিস্মিত হলাম। স্ত্রী পুত্র মায়ের কথা বললেন অথচ বাবার কথা বললেন না দেখে! 
উনি কি করে জানেন আমি পিতৃহীন! কিছুই মাথায় ঢুকছেনা হঠাৎ বাবার মুখটা ভেসে উঠলো।
বাবাকে কবরে নামানো হবে। কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচেই সাড়ে তিন হাত কবর। শেষবারের মত দেখানো হচ্ছে বাবার মুখ। ভাই আত্মীয় স্বজন সবাই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। দূরে দাঁড়িয়ে দুই বোনের আর্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আজ সেই মুখটাই যেন আমার সামনে। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। দাঁড়াতে পারলাম না। হাত ধোঁয়ার বেসিনের দিকে দ্রুত ছুটে গেলাম যাতে বৃদ্ধটা চোখের জল দেখতে না পায়। হুহু করে উঠল বুকটা। 
হোটেলে কোনো গ্রাহক নাই। টেবিলগুলো খালি। হাত ধুয়ে মুছে টেবিলে আসতেই চমকে উঠলাম। টেবিলটা খালি। টেবিলে কোনো থালাবাসন জগ গ্লাস কিছুই নেই। বৃদ্ধ লোকটি কোথায়? এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে হাওয়া হয়ে গেলেন কী করে?  বিশ্বাস হচ্ছিল না। বয় দাঁড়িয়ে ছিল টেবিলের পাশে। কাছে আসতেই মুখ মোছার জন্য টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল। ছোট্ট চায়ের প্লেটে খাবার বিল। বিলটা হাতে নিয়ে আরেক চমক। মাত্র একজনের খাবার বিল। কি ব্যাপার দুজনের খাবারতো এই ছেলেটাই দিল! ও কি জানেনা? ও যেন আমার অপেক্ষায় তাড়াতাড়ি আমার ব্যাগটা ওর কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। মানি ব্যাগ থেকে দুটো একশ টাকার নোট বের করে ওকে দিলাম ও পকেট থেকে বাকী টাকা বের করে ফেরত দিল। বললাম তুমি রেখে দাও। ও একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললো। স্যার চলেন। আইজকা অনেকক্ষণ ধইরা বুড়া মাইনসের মত চিবাইয়া চিবাইয়া ভাত তরকারি খাইছেন আর কেবল কান্না কইরছেন। মনটা বুঝি বেশী খারাপ?
হোটেলের পাশের পান সিগারেটের দোকানটা বন্ধ করছে দোকানি। একটা মিষ্টি পান আর সিগারেট কিনলাম। পান মুখে দিয়ে সিগারেট ধরালাম। রাস্তায় সুনসান নীরবতা। মৃদু শীতল হাওয়া বইছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে। খাওয়াটা বেশ তৃপ্তিদায়ক ছিল। সিগারেট থেকে গাল ভর্তি ধোঁয়া নিয়ে ধীরে ধীরে বাতাশে উড়িয়ে দিলাম। দেরি হয়েছে অনেক। বাসটা নিশ্চয়ই ছেড়ে গেছে। এখন কোথায় যাবো? বাস ট্রেন কিছুই নেই। আশে পাশে কোনো হোটেল আছে কিনা জানিনা। বয়টা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাস স্ট্যান্ডের উজ্জ্বল বাতিগুলো নেভানো। মনে হচ্ছে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। 
দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। দরজার কাছে বাসের হেলপার হাত দিয়ে ইশারা করছে দ্রুত আসতে।
ঝকঝকে তকতকে নতুন এসি বাস। আজ সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। রাত পৌনে একটা। বাস পাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। বাসটা যেন আমার অপেক্ষায় ছিল। বাসে উঠে বসলাম বেশীরভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে। বেনাপোল থেকে বাস দেরীতে ছেড়েছে পথে যান্ত্রিক ত্রুটি সারানোর কারণে বিলম্ব। তাই রক্ষে।
ঢাকা থেকে তোলা শেষ যাত্রীকে নিয়ে বাস চলতে শুরু করলো। মাথার ওপরের বাতিগুলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দিলাম। অনেকে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম হোটেলে দেখা সেই বৃদ্ধের কথা। আমার বাবার কথা। কি প্রশান্তি অনেকদিন পর বাবাকে আবার দেখলাম। এটা কি করে সম্ভব? ভাবতে ভাবতে এক সময় হারিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
জানালা ভেদ করে ভোরের সূর্যের আলো বাসের ভেতরে। আমার পাশের সারির আসনে মায়ের কোলে পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে ছোট্ট একটি মেয়ে তার গালে ভোরের কুসুম উষ্ণ রোদ। কী মিষ্টি মেয়েটা। ইচ্ছে হচ্ছে ওর গালে একটু চুমুর পরশ বুলিয়ে দিই। বাস থেমে গেছে। পৌঁছে গেছি আমার শহরে। দরজার পাশে অপেক্ষমান একটি বাস। তার গায়ে লেখা ‘বাবার দোয়া’। রাতের সেই বৃদ্ধের কথা আবার মনে হলো। উনি বলেছিলেন। ‘বাবা দোয়া’ করি তুমি যেন নিরাপদে তোমার বউ, বাচ্চা আর মায়ের কাছে পৌঁছুতে পারো’…।
 
        
