কানাডার প্রধানমন্ত্রীর আঠারো বছরের সংসার ভেঙে যাওয়ায় আমাদের বাংলাদেশে ঘরে–বাইরে, হাটে–মাঠে–ঘাটে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ঝড় উঠেছিল তার রেশ চলেছিল টানা অনেকদিন। ঘর ভাঙার দায় কিংবা অভিযোগের তীর প্রাথমিকভাবে স্ত্রী–জাতির ওপর গিয়ে পড়ে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাস্টিন ট্রুডোর দ্বিতীয় স্ত্রী সোফিকে অভিযুক্ত করতে গিয়ে বাঙালি বিশ্লেষকগণ ঘুরতে শুরু করেন আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অলি গলি ও জনপদে। তালিকা তৈরি করেন দেশে বিদেশে ঘর ভাঙা তারকাখ্যাতি পাওয়া দম্পতিদের। তাদের সম্পর্কের ভাঙা গড়ার চুলচেরা পর্যালোচনা করেন, বিতর্কেও ঝড় বইয়ে দেন, সেই সঙ্গে বিষেদ্গার উগড়ে দেন নারীজাতির প্রতি। ডিজিটাল বিতর্কসভার ব্যপ্তি দেখে মনে হতে পারে আমাদের নাগরিক জীবন বড়ই সুখে শান্তিতে অতিবাহিত হচ্ছিল; ট্রুডোরাই বুঝি সকল সুখ শান্তি কেড়ে নিল, বাড়া ভাতে ছাই দিল। ট্রুডো ঝড়ের কবলে পড়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতিবান ও সচেতন নাগরিক সমাজ বেমালুম ভুলে যায় দেশজুড়ে চলতে থাকা ডেঙ্গু মহামারীর কথা। আমাদের নগরপিতাগণ মশা মারতে কামান দাগান, মশার ওষুধ খুঁজে আনতে বিদেশ সফরে যান, মহাসমারোহে মশা দিবস পালন করেন, সম্মেলনে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে মঞ্চ কাঁপান। কোনো কিছুই দমাতে পারেনা মশককুলকে। সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে মৃতের সংখ্যা চার অংক ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ শিশু। রাজধানীর বুকে এক বাবা এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই সন্তানকে সমাহিত করেছেন। মায়ের দিন কাটে ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়, খেলনা আর বইখাতা দেখে দেখে। প্রতিদিনই আসছে কোন না কোন শিশু, কিশোর, তরুণের মৃত্যু সংবাদ, যাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নেওয়া যায়না। প্রতিদিনের খবরের কাগজে হাসপাতালগুলোর যে চিত্র আসে তা কেবল অমানবিক আর অস্বাস্থ্যকরই নয়, বরং বীভৎস। অব্যবস্থাপনার চরম দৃষ্টান্ত আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দীনতাকে ফুটিয়ে তুলছে নির্মম আর নির্লজ্জভাবে। এই দীনতার সঙ্গে অর্থহীনতার সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া ঠিক হবে না। নিদানকালেও থেমে নেই অর্থের ওড়াউড়ি। যে পারছে পেড়ে নিচ্ছে, আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। দেখেশুনে মনে হয় দেখার কেউ নেই, কারও কোনো দায় নেই। যে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত জাতি ঘরে ঘরে যা কিছু আছে তাই নিয়ে উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল, তাদের পরাস্ত করেছিল, সেই জাতি এখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মশক বাহিনীর সামনে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। তবু থেমে নেই কর্তাব্যক্তিদের আস্ফালন। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, দেশ দরদী জননেতা, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একে অন্যকে দোষারোপ করে চলেছেন, যা মোটেও নতুন কিছু নয়। এ–আমাদের দীর্ঘ অর্ধ শতকের সংস্কৃতি।
কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপে মানুষ মরছে তা নয়, সড়কে নদীতে পাহাড়ে নর্দমায় অলিতে–গলিতে ঘরে বাহিরে বিচিত্র সব কারণে প্রাণহানি ঘটে। গলিত অর্ধগলিত লাশ, খণ্ডিত কংকাল কত কি যে আবিষ্কৃত হয় সমাজের আনাচে–কানাচে! কোনো মৃত্যুকে দুর্ঘটনাকবলিত মৃত্যু বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যমদূত বুঝিবা ‘ওভারটাইম’ করছেন বঙ্গ জনপদে। দম ফেলারও সময় নেই তাঁর। মহামারীর মাঝেও সরগরম রাজনীতির মাঠ। আরও উত্তপ্ত হচ্ছে দিনকে দিন। আগুন নেভাতে পানি ঢালার কেউ নেই, তবে আগুনে ঘি ঢালা মানুষের অভাব নেই। অমর কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের ‘আগুন জলেরে, নেভানের মানুষ নাই, কাইজার বেলায় আছে মানুষ, মিলের বেলায় নাই’– গানটির মতো। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এ আগুন নেভাতে কেউ চায়না। আগুন জ্বলতে থাকুক– রথী মহারথীগণ তাই–ই চান। যত আগুন জ্বলে ততই তাঁদের আখের গোছানোর পথ খুলে যায়। আগুন নিয়ে খেলায় মাতেন তাঁরা।
আমরা প্রতিনিয়তই গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করি– শহর উপশহর পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গিয়েছে বিদ্যুৎ। হারিকেন, কুপিবাতিকে যাদুঘরে প্রেরণের সময় এখন। কিন্তু বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা তা হতে দিচ্ছে না। বিদ্যুৎ নির্ভর যন্ত্রপাতি থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফলতো পাওয়া যায়ই না, উপরন্তু প্রাণহানির খবরও আসে। ঘাস কাটার যন্ত্র চালু করতেই চলে গেল বিদ্যুৎ। বোতাম টিপে যন্ত্রটিকে বন্ধ করার কথা ভুলে যায় শ্রমিক। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে শুরু করে যন্ত্রটি। ঘাস কাটার পরিবর্তে মুহূর্তেই হাত থেকে কব্জি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিশোর শ্রমিকের। কব্জি কেটে গেলেও প্রাণে বেঁচে যায় সে। এটা তার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য তা অবশ্য গভীর ভাবনার বিষয়। তবে অতর্কিতে বিদ্যুৎ ওঠানামার কারণে ঘরে–বাইরে প্রাণহানিও অহরহ ঘটে থাকে। ভাদ্রের এক সন্ধ্যায় রাজধানীর বুকে জল থৈ থৈ এর সময় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে তড়িতাহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চার–চার জন মানব সন্তান, নাগরিক সমাজে এ ঘটনা তেমন ঝড় তুলেছে বলে শোনা যায়নি। তবে পরিমনির ঘর ভাঙল কি জোড়া লাগল, সে খবরে আমাদের উৎসাহের সীমা নেই। বড় অদ্ভুত অন্তঃসারশূন্য এক উন্মাদনায় মেতে আছে নাগরিক সমাজ। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা, সাংস্কৃতিক বৈকল্য জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আমাদের শিক্ষা আমাদের অন্তর্চক্ষু উন্মীলিত করে না, চোখের সামনে ঝুলে থাকা অন্ধকার পর্দাটা সরিয়ে দেয় না। একথা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য যে আমাদের শিক্ষালয়ে সব আছে, শিক্ষা ছাড়া। শিক্ষা যদি আলোই না ছড়ায়, মানবিকতার বিস্তার না ঘটায় তবে কেন এত ঢাকঢোল পিটিয়ে সোনালি ফলাফল উদযাপন করা?
মেঘে মেঘে কম তো বেলা হয়নি। আর কতোকাল আসল দুঃখ ভুলে অলীক সুখে বিভোর হয়ে থাকব আমরা! পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য সমাজ গড়ায় এখনই মন না দিলে স্বাধীনতার গৌরব ছাইভস্মের মতো অর্থহীন হয়ে পড়বে। এ কাজ কে করে দেবে আমাদের? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ? রাজনীতিবিদগণ? নাগরিকের কোনো দায়ই নেই? আমাদের কাজ কি কেবলই অভিযোগ করে যাওয়া ? আমরা যদি কেবল চাই আর চাই, আর খাই খাই করে যাই তবে কোনো বিশ্বসেরা নৃপতিই নন, আকাশ থেকে দেবদূত নেমে এলেও আমাদের দুর্ভোগের অবসান হবে না।