অর্ধশতাধিক স্থানে নিত্য ছিনতাই

দেড় মাসে শুধু সিআরবিতে ২০ ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক গ্রামের ৩২ নারী ছিনতাইকারী চট্রগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্যণীয় নয়

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

নগরীর বিভিন্ন স্পটে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে মানুষ। ছিনতাইকারীদের প্রায় সকলেই নোয়াখালী, বরিশাল, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিবাসী। এছাড়া যে ক’জন চট্টগ্রামের স্থানীয়, তাদের দলে রাখা হয় মূলত এলাকা চেনার সুবিধার্থে।

 

নিত্যনতুন কৌশলে তারা প্রতিনিয়ত ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। গ্রুপের কেউ ধরা পড়লে তারা তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে। ছিনতাই কাজে তাদের পছন্দের বাহন সিএনজি টেক্সি, মোটরসাইকেল। তবে ইদানীং প্রাইভেট কার নিয়েও তারা বের হয়।

নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। মাঝেমধ্যে অভিযান ও গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সিএমপির (চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ) ১৬ থানা পুলিশ।

ছিনতাইকারী, টানা পার্টি, মলম পার্টি, গামছা পার্টি, অজ্ঞান পার্টির দলনেতা, মূলহোতা গ্রেপ্তার বলা হলেও নগরীতে এসব অপরাধীর দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পারছে না পুলিশ। যার কারণে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারী প্রতারকসহ বিভিন্ন অপরাধীদের টার্গেট হচ্ছে। প্রতিদিনই নগরীর কোথাও না কোথাও ছোটবড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। রিকশা থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল ও হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা নিত্যদিনের। টহল পুলিশের তৎপরতা কাগজে কলমে। যার ফলে এই সুযোগটাই কাজে লাগচ্ছে অপরাধীরা।

দুএকটি ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশি ঝামেলার কারণে অনেকেই থানায় মামলা করেন না। মামলা হলেও ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করতে পারছে না পুলিশ। তবে পুলিশের দাবি গ্রেপ্তার অভিযান ও টহল অব্যাহত আছে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরীতে কতজন ছিনতাইকারী রয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই পুলিশের কাছে।

কারা কারাগারে আছে, আর কারা জামিনে বেরিয়ে এসেছে সেই তথ্যের হালনাগাদ নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অপেশাদার ছিনতাইকারী। নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে সুযোগ পেলেই ছুরিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পথচারী ও যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে চলতি মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র সিআরবি শিরীষ তলাকে কেন্দ্র করে বিশটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

সিএমপির ওসি কোতোয়ালী মো. জাহিদুল কবীর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে আজাদীকে বলেন, ওই স্পট সম্পর্কে আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে। বয়লার কলোনি, লালখানবাজার ও টাইগারপাসের তিনটি গ্রুপ এখানে মূলত মোবাইল ফোন ছিনতাই করে। আমরা গত সপ্তাহে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে একটি গ্রুপকে গ্রেপ্তার করেছি। শুধু সিআরবি এলাকা নয়, নগরীর মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, ২ নম্বর গেট, কাজীর দেউড়ি, বিবিরহাট, পূর্ব নাসিরাবাদসহ অর্ধশতাধিক স্থানে ছিনতাই হচ্ছে হরহামেশা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষিকা আজাদীকে জানান, গত মঙ্গলবার দুপুরে টিউশন শেষে বাসায় ফেরার পথে নিউমার্কেট অতিক্রম করার আগেই ছিনতাইকারী ব্যাগ টান দিয়ে দৌঁড় দেয়। লোকজন এসে ছিনতাইকারীকে আটকে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেয়। মোবাইলটা পেয়েছি, তবে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাগটা পেলেও টাকা ফিরে পাইনি। ঠিক দুই বছর আগেও একই জায়গায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছি।

ছিনতাইকারীদের হালনাগাদ তথ্য না থাকায়, পুলিশের তৎপরতা কমায় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলো এখন অনিরাপদ। নগরীর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এসব ঘটনা থানায় জানালে তেমন অগ্রগতি হয় না। নামমাত্র ছিনতাইকারী দলের কথিত দলনেতা গ্রেপ্তার করে আনা হয়। কয়দিন পর আবারও নেমে পড়ে অপরাধীরা। এসব ছিনতাইকারীকে নেশাগ্রস্ত ও মাদকসেবী এবং ভবঘুরে বলে আখ্যা দেয় আইনশৃক্সখলা বাহিনী। যার ফলে অপরাধীরা বারবার এমন কর্মকাণ্ড করে পার পাচ্ছে।

সিএমপির সূত্র মতে নগরীতে ছিনতাই কাজে জড়িতদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের স্থানীয় নয়। ছিনতাই গ্রুপগুলোর মধ্যে ঢাকা থেকে দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে জামালকামাল দুই ভাই। এ দুটি গ্রুপের ৩৫ জন সদস্যের প্রায় সকলেই বরিশালের লোক। রয়েছে নুরুল আলম গ্রুপ, নূর

হোসেন গ্রুপ ও আলমগীর গ্রুপ। এ তিনটি গ্রুপ আগে এক থাকলেও পরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিনটি গ্রুপ তৈরি করে। নোয়াখালী কেন্দ্রিক গ্রুপ তিনটির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে চট্টগ্রামে। এছাড়া কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের নোয়াপাড়া গ্রামের জসীমের নেতৃত্বে কুমিল্লা গ্রুপ, যশোরের সাইফুল আলম স্বপন গ্রুপ, কুমিল্লার নাজির উদ্দিন নাইজ্যা গ্রুপ, ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রফিককবির গ্রুপ, নোয়াখালীর নাজিম

গ্রুপ ও নোয়াখালীর আপেল মিন্টু গ্রুপ ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে সামপ্রতিক অভিযানে বেশ ক’জন ধরা পড়েছে কিন্তু বাকিরা ঠিকই সক্রিয় রয়েছে।

শীর্ষ সন্ত্রাসী হাত কাটা ইদুর ইন্ধনে চলছে কয়েকটি কিশোর গ্যাং। নগরীর বিআরটিসি বয়লার এভিনিউ কলোনি ও পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কিশোর অপরাধ। বহু মামলার আসামি হাত কাটা ইদু কিশোর অপরাধীদের দিয়ে এসব অপরাধ করাচ্ছে।

১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী ২০ জনের মতো কিশোর হাত কাটা ইদুর হয়ে কাজ করে। ভাসমান এসব শিশুদের কারও কাজ সকালে মাছ বোঝাই রিকশাভ্যান যাবার সময় মাছ চুরি করা, কারও কাজ ফলের ভ্যান থেকে ফল চুরি, রেলস্টেশনের যাত্রীদের ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কিংবা পকেট কাটা অথবা মাদক বিক্রি। রেলওয়ে স্টেশন, বিআরটিসি এলাকায় হাত কাটা ইদুর বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে যারা এ শিশুকিশোরদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে।

চট্টগ্রামে নারী অপরাধীদের প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ধরমন্ডল গ্রামটিকে বলা হয় নারী ছিনতাইকারী তৈরির কারখানা! সত্যিই তাই। ধরমন্ডল গ্রামের অন্তত পেশাদার ৩২ নারী ছিনতাইকারীর নোঙর এখন বন্দর নগরে।

পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রাম নগর ও শহরতলীতে ছিনতাই করে তারা ‘জাত’ চেনাচ্ছেন। ধরমন্ডল গ্রামের দুই বাড়ির ২৮ নারী ছিনতাইয়ে জড়িত। একটি বাড়ির দুর্ধর্ষ ২০ নারী ছিনতাইকারীর নাম রয়েছে পুলিশের খাতায়। আরেক বাড়ির আছে আটজন। তাদের কারও নামে পাঁচটি, কারও চারটি, কারও নামে তিনটি করে ছিনতাই মামলা ঝুলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে
পরবর্তী নিবন্ধঅংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায়িত্ব শুধু সরকারি দলের নয়, বিএনপিসহ সকলের : তথ্যমন্ত্রী