অর্থ পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে

| শনিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ প্রকাশ অনুষ্ঠানে অর্থ পাচার সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। আসলে দেশে থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বিগত অনেক বছর ধরেই তা চলছে এবং দিন দিন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনোভাবেই অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধগুলো বিশ্বের যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে; দেখা যাচ্ছে, সেখানে দুদকের মতো দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। মানি লন্ডারিং আইনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দুদকের হাতে থাকাকালীন ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনায় দুদকের সাফল্য থাকলেও পরে এ বিষয়ে সাফল্যের আর কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায় দুদকের ক্ষমতা ও আইনি কাঠামো যে আরও সমপ্রসারিত করা দরকার, তা বলাই বাহুল্য।
অতি সমপ্রতি বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ চাইলে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকের যে অর্থ জমা বা লেনদেন হয় তার তথ্য পাওয়া সম্ভব, তা বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাঁর মতে, বাংলাদেশ তা অনুসরণ করে এখনো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের কাছে জানতে চেয়েছেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে কি না। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুইস রাষ্ট্রদূত সুইস ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশিদের অর্থ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থসচিব আগে জানিয়েছিলেন যে তথ্য চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু সুইস ব্যাংক কোনো উত্তর দেয়নি।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, সুইস ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি গন্তব্য মাত্র। সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশিরা আট হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে জমা করেন, যার অংশবিশেষ বৈধ লেনদেনও হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিয়ে সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যতই হোক, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অন্য আরও অনেক গন্তব্যে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থসম্পদ প্রতিবছর পাচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো গন্তব্যের পাশাপাশি ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ এবং তথাকথিত করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অনেক অফশোর অঞ্চল বাংলাদেশি অর্থ পাচারের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বলে জানা যায়।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার আশা করছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে হারে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে এবং এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, তাতে এসব লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁরা বলছেন, উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে আবশ্যিকভাবেই কয়েকটি বিষয়ের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বৈষম্য হ্রাস এবং বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এসব মৌলিক উপাদানগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাহত হতে পারে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা গতিশীল রাখতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে দেশের টাকা দেশে থেকে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ধরনের পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি না পারছে অর্থ পাচার রোধ করতে, না পারছে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে, না পারছে নিজের চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে। দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অথচ তা রোধ করা যাচ্ছে না, এটা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, অবৈধভাবে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ অর্থ পাচারকারীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। অর্থ পাচার রোধে অবশ্যই পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে