অরুণ দাশগুপ্ত ‘মোর লাগি করিও না শোক’

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১১ জুলাই, ২০২১ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ


প্রিয়ভাজন রাশেদ রউফের পোস্টটা দেখে হজম করার আগেই দেখি বন্ধু ওমর কায়সারের ম্যাসেজ। আমাদের প্রিয় অরুণ দা সকলের দাদামনি শেষ বিদায় জানিয়েছেন তাঁর জন্মভূমিকে। দূর দেশের এক শহরে বর্ষণক্লান্ত দুপুরটি আমাকে নিয়ে গেলো অনেক দূরে। আমার যৌবন ও যৌবন পেরিয়ে আসা দিনগুলোতে। সে এক আশ্চর্য বিস্ময়ের সমাজ। এখনকার চাইতে অগ্রসর ও মেধার আলোকিত দেশ। যেখানে ামরা সাহিত্য শিল্প চর্চা করতাম প্রাণের আনন্দে। চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্যের মুখপাত্র আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক অরুণ দা ছিলেন লেখক তৈরী ও সমাজ নির্মাণের নেপথ্য কারিগর। প্রচার বিমুখ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার পর ও নিরাসক্ত এক মানুষ।
তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা আমার জন্য দুরূহ। একদিকে যেমন ঋণের বোঝা অন্যদিকে অসংখ্য অসামান্য সব স্মৃতি। সীমিত পরিসরে এমনকি বিপুলায়তনেও সবকিছু লেখা অসম্ভব।চিনতাম কৈশোর কাল থেকে। বিশেষত নন্দনকানন ও লাভ লেইনে বড় হওয়ায় তাঁর বাড়ীটি বলা উচিৎ তাঁর থাকার জায়গাটি ছিলো হাতের মুঠোয়। কিন্তু পথে ঘাটে দেখা হলে একঝলক কুশল বিনিময় বা টুকটাক কথা ছাড়া তেমন কোন সম্পর্ক ছিলো না। আমরা তখন ঢাকার তথা জাতীয় নামে পরিচিত দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিকের নিয়মিত লেখক। আমাদের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী। এর বাইরে তখন আমরা কবিতা নিয়ে একটি পাঠচক্রে নিমগ্ন।
আশির দশকের শেষদিকে নানা কারণে আমি আমার মতো চলার সিদ্ধান্ত নেই। নানা ঘটনাও ঝুট ঝামেলায় এটা পরিষ্কার হয়ে পড়ে অভিভাবক বলে মান্য করার মানুষ নিজে ওপরে ওঠা ব্যতীত কিছু বোঝেন না। যৌবনের স্বভাবধর্মে তখন কাছের জনদের সাথেও সম্পর্ক হয়ে ওঠে অম্লমধুর।
এমন কঠিন সময়ে তাঁর সাথে গড়ে ওঠে নিবিড় এক সম্পর্ক। আজাদীও তখন নতুন ভাবে নবরূপে বেরিয়ে আসার জন্য মুখিয়ে। রাশেদ রউফের মতো তরুণ তুর্কীরা ঢুকেছে আজাদী হাউসে। বন্ধুপ্রতিম প্রদীপ দেওয়ানজী বিজ্ঞ ইউসুফ ভাই সবার ওপর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সব মিলিয়ে রসঘন ফের গুরুত্বপূর্ণ আড্ডা।বলাবাহুল্য আড্ডার জায়গা এনায়েত বাজার বৌদ্ধ মন্দিরের উল্টো দিকের ছায়াঘন এক বাড়ী। ডাঃ কেশব সেনের সেই বাড়ীটি হাত বেহাত হতে হতে এখন এক বহুতল ভবন। তখনকার দোতলা বাড়ীর ঢোকার মুখে একতলার বাঁ দিকে একটি ঘরে থাকতেন তিনি। হররোজ যেতে যেতে এমন অবস্থা হয়ে গেলো সে বাড়ীর কেয়ার টেকার থেকে শুরু করে গাছপালাও চিনে গেছিল আমাকে।
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম তাঁর মেধাও মনন কতোটা পরিশীলিত। কি পরিমাণ জানাশোনা ও পড়ালেখা তাঁর। শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিলো অসামান্য। চট্টগ্রামের হেন কোন কবি লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ নাই যারা সেখানে যেতেন না। আওয়ামী লীগের মেয়র মহিউদ্দিন ভাই অন্যদিকে বিএনপির নোমান উভয়কে দেখেছি তাঁর বাসায়। দু জনই এসেছিলেন দোয়া চাইতে।
কয়েক শ কবি লেখক সাহিত্যকর্মীর জন্মদাতা তিনি।
সে আড্ডায় মসজিদের ইমাম থেকে চট্টেশ্বরী কালীবাড়ির পুরোহিত সবাই আসতেন। লাকী হোটেলের চা সমুছা বিস্কিট অমৃতি চলতো সমানে। অন্য পত্রিকার সাংবাদিকরাও আসতেন। এমন মিলনস্থল দেখি নি আর।
সময় গড়িয়ে সম্পর্ক গভীর হলে অনেক অজানা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতেন। একসময় এমন হয়ে গেলো তিনি কোথাও গেলেই নিয়ে আসতেন কোন না কোন উপহার। দিল্লী থেকে এনে দেয়া গান্ধীর অটো বায়োগ্রাফী এখনো শোভা পাচ্ছে আমার সিডনি বাড়ীর বইয়ের সেলফে।
অধিকারবোধ থেকে ঝগড়াও হতো মাঝে মাঝে। আমার অভিযোগ ছিলো তিনি তাঁর কথার প্রেমে পড়ে লেখা খুইয়ে ফেলছেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তাঁর হয়তো একটি বা দুটি গ্রন্থ ছিলো হয়তো বা একটিও না। ভয় পেতাম সময় কি এই জনপ্রিয় সাহিত্য সম্পাদক ও অতিথি বৎসল মানুষটিকে মনে রাখবে? কবিতা শিল্প নিয়ে চায়ের আড্ডায় একটু আগে ফাটাফাটি করে আসা দু দল কবি, লেখক এসে একসাথে চা পান করতেন তাঁর বাসগৃহে, এমন ক্যারিশমার পরও তাঁকে মনে রাখবো কি আমরা?
পোড়ার সমাজে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক। চট্টগ্রাম যতোই রাজস্বের যোগান দিক যতোই মেধার সাম্রাজ্য হোক ঢাকার একচোখা দৃষ্টিতে মফস্বল। আর এই মফস্বলের হৃদয়বান মেধাবী সাহিত্য সম্পাদককে তারা না চিনবে না সম্মান জানাবে। আজ যখন তাঁর চলে যাবার খবর পেলাম মনে হলো মানুষটি না পেয়েছেন কোন জাতীয় পুরস্কার পদক না সম্মাননা। না জানতেন লবিং না তৈল মর্দন।
তাঁর কাজের জায়গা তাঁর পরিচয় তাঁর প্রিয় আজাদী তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছে। শ্রদ্ধাভাজন মালেক সাহেবের আদেশে টাকা পয়সার অভাব হয় নি শেষ বয়সে। এখন তিনি সবকিছুর বাইরে এক আলোর খেয়ার যাত্রী।
সবাই তাঁকে দাদা মনি বলে ডাকতো। ইচ্ছে করেই আমি ডাকতাম দাদা। অনেকে এও মনে করতেন পদবী দাশগুপ্ত বলে তিনি আমার বড় দাদা। দাদা তো বটেই। তবে রক্তীয় কেউ না আত্মার আত্মীয় । দীর্ঘ সময়ের এক স্বজন বড় ভাই এবং অভিভাবক হারানো সিডনি সন্ধ্যাটি চোখ ছলছল করে দিলেও আমি কাঁদবো না। বরং বলবো দেখো অরুণ দাশগুপ্তকে দেখো। শেখো জীবন কে উদযাপন করা কাকে বলে। শেষ বয়সে নিঃসঙ্গ যাত্রা হলেও সারাজীবন মানুষের মনে ছিলেন থাকবেন অরুণ দাশগুপ্ত। প্রণাম দাদা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের নগরের এক সুবাসিত কবি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রেমের ফাঁদ পেতে বাসায় ডেকে এনে জিম্মি