অরক্ষিত উপকূল, ডেল্টা প্ল্যানেই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা

কাল ভয়াল ২৯ এপ্রিল

চকরিয়া প্রতিনিধি | শুক্রবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় সমুদ্র উপকূলের ইউনিয়নগুলোর বেশকিছু এলাকা এখনো অরক্ষিতই পড়ে রয়েছে। উপকূলের এসব ইউনিয়নকে সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় পৃথক বড় প্রকল্প তৈরি করে তা বাস্তবায়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হলেও কার্যত স্থবির হয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় উপকূলীয় মানুষের জানমালের রক্ষাকবচ সমুদ্র উপকূল এবং তৎসংলগ্ন ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। আর এরই মধ্যে চলে এসেছে চট্টগ্রামকক্সবাজার উপকূলে সেই ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘হ্যারিকেন’ আঘাত হানার দিনটি। আগামীকাল শুক্রবার ৩২ বছর পূর্ণ হবে সেই কালরাত্রির। সেই রাতে এই ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় উপকূলের লাখো মানুষের প্রাণ। তাদের মধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়ই অন্তত ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে প্রাণ যায় লাখ লাখ গবাদি পশুর। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উপকূলীয় এলাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিণত হয় বিরানভূমিতে।

২৯ এপ্রিল রাতের সেই বিভীষিকা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠে উপকূলের মানুষ। স্বজন হারানোর বেদনায় তাড়িত হয় তারা। দিনটি স্মরণে উপকূলের বিভিন্ন সংগঠন স্মরণসভাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কর্মসূচি পালন করে আসছে। মূলত তৎসময়ে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় উপকূলীয় এলাকা রাতের মধ্যেই বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল।

অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আর অপরিকল্পিত কোনো কাজই হবে না। সেটি সমুদ্র উপকূলের বেড়িবাঁধ বা নদীতীরের বাঁধ হোক। মূলত প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডেল্টা প্ল্যানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের আগামীর সম্ভাব্য উচ্চতাকে প্রাধান্য দিয়েই সমুদ্র উপকূলের বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণ করা হবে। তবে এই কাজ বাস্তবায়ন হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে।

চকরিয়ার বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, চিরিঙ্গা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, ডুলাহাজারা ও পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা দৈনিক আজাদীকে জানান, এসব ইউনিয়নের বেড়িবাঁধগুলো নির্মিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী। এরপর মাঝেমধ্যে সমস্যা বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে আপদকালীন কিছু কাজ করা হলেও কার্যত ভঙ্গুর ও জরাজীর্ণ অবস্থায়ই রয়েছে বেড়িবাঁধগুলো। এতে ১৯৯১ সালের মতো ফের যদি বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে না আগের মতো।

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইউনুস চৌধুরী জানান, বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপন করায় কাঁকপাড়া বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণকাজ চলছে। বর্তমানে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে শরত্‌ঘোনা থেকে মগনামা জেটিঘাঁট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাবুল জানান, ভাঙাখালী মাতব্বর পাড়া থেকে সুন্দরীপাড়া পর্যন্ত ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ একেবারেই জরাজীর্ণ। উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোফাজ্জল করিম জানান, করিমদাদ মিয়ার ঘাঁট থেকে পূর্বদিকে ৫২ নম্বর পোল্ডারের স্লুইস গেট পর্যন্ত ১ কিলোমিটার এবং রূপালী বাজার, টেকপাড়ার দিকে সমুদ্র উপকূলের প্রায় ৫০ চেইন পর্যন্ত একেবারেই অরক্ষিত।

চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূরে হোছাইন আরিফ জানান, দক্ষিণ মাথার ফিশারী ঘাঁট থেকে নাপিতখালী হয়ে মামাভাগিনা পাড়া পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। শুধু সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ার নয়, ভারি বর্ষণ হলেই সেই ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ বিলিন হতে সময় লাগবে না।

পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ৬৫ নম্বর পোল্ডারের চৌঁয়ারফাঁড়ি, ফুলতলা, ডেবডেবি, লম্বাখালী এলাকার সমুদ্র উপকূলের প্রায় ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ একেবারেই বিলিন হয়ে রয়েছে। ফুলতলার ভাদিবইন্যা পয়েন্টের বেড়িবাঁধসহ স্লুইস গেটটির অবস্থা এমন নাজুক যে, বৃষ্টিপাত শুরু হলে এবং সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে যেকোনো সময় পুরো বিলিন হয়ে পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী ইউনিয়ন তলিয়ে যাবে।

উপকূলীয় চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, সওদাগরঘোনা, চরণদ্বীপ, বুড়িপুকুর এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকায় যেকোনো সময় চিংড়িজোনসহ বিশাল এলাকা তলিয়ে যাবে। ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর জানান, তার ইউনিয়নের পশ্চিমাংশের বিশাল চিংড়িজোন ও লবণমাঠ এলাকা সমুদ্র উপকূলে। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় ওই এলাকার। বিশেষ করে লম্বাঘোনা এলাকার বেড়িবাঁধটি খুবই জরাজীর্ণ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড পওর বিভাগের শাখা কর্মকর্তা মো. জামিল মোর্শেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, চকরিয়ার বিভিন্ন উপকূলীয় ইউনিয়নের বেড়িবাঁধগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। তদ্মধ্যে ৩৬ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধ ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সেই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন অংশের ২৭ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণের জন্য ব্লক বসানো, বাঁধ উঁচুকরণ, রেগুলেটর (স্লুইস গেট) স্থাপন, খাল খনন, সংস্কারসহ টেকসইভাবে নির্মাণের জন্য বড় একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির পর পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২২ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। যদিওবা সেই প্রস্তাবনার ওপর এখনো কোনো তৎপরতা নেই ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কঙবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, কঙবাজারের সমুদ্র উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে বড় প্রকল্প তৈরি করে ঢাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রেরিত প্রস্তাবনার ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

কঙবাজার১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, উপকূলের মানুষকে রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ চলমান। আর মগনামা ইউনিয়নের বিশাল এলাকা আগে অরক্ষিত থাকলেও সেখানে দেশের প্রথম বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন নৌঘাঁটি স্থাপন হওয়ায় টেকসইভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বেড়িবাঁধ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডেল্টা প্ল্যানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই উপকূল রক্ষায় অনেক উঁচু করে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজও শুরু হবে। সেজন্য সরকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ শেখ জামালের জন্মদিন আজ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬