অমৃতা প্রীতমের কবিতা

ভূমিকা ও ভাষান্তর

কাজী সাইফুল আচফিয়া | শুক্রবার , ৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ

অমৃতা প্রীতম ১৯১৯ সালে অবিভক্ত পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালাতে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাবি ভাষার প্রখ্যাত এই কবি, উপন্যাসিক ও গল্পকার ভারত ও পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয়। তাঁর রচিত অনেক কবিতাই গীত হয়েছে গুলজারের মতো বিখ্যাত সব শিল্পীদের কন্ঠে। তাঁর গল্প ও উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে কালজয়ী অনেক সিনেমাও। সম্মানিত হয়েছেন অনন্য সব সম্মাননায়। তিনিই সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত প্রথম নারী কবি, ভূষিত হয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’-এ। তিনি ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মবিভূষন’ সম্মাননায়ও ভূষিত হন। তিনি ‘যাপন করেছেন স্বপ্নের এক জীবন যেমনটা তিনি কল্পনা করেছেন’ অমৃতা প্রীতমের জন্মশতবার্ষিকীতে গুগল তাঁর সম্মানে যে ডুডল করে তাতে তাঁকে উৎসর্গ করে লেখা হয় এই লাইন। তা অনেকাংশেই সত্যি। ভারত ভাগের দগদগে স্মৃতি নিয়ে জন্মভূমি পাঞ্জাব থেকে উদ্বাস্তু হয়েও যিনি যাপন করেছেন এক স্বপ্নের জীবন। প্রেম করেছেন আরেক কবি, বিখ্যাত শায়ের শাহির লুদিয়ানভীর সাথে, পরে আমৃত্যু কাটিয়েছেন আরেক বিখ্যাত শিল্পী, চিত্রকর ইমরোজ এর সাথে। তবুও যেন তিনি ছিলেন সত্যিকারের এক পাঞ্জাবদুহিতা, ভারত ভাগের যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমৃত্যু। তিনি যেন তাঁর প্রিয় কবি, পাঞ্জাবের বিখ্যাত চিশতি সুফি দরবেশ ও কবি, ওয়ারিশ শাহের সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র হীর যে তার প্রেমের জন্য কেঁদে ফেরে পাঞ্জাবের লোক লোকান্তর। তাই যখন পাকিস্তানের পাঞ্জাব একাডেমি তাকে তাঁর জীবন সায়াহ্নে পুরস্কৃত করেন এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ভাষার কবিরা তাঁর জন্য ওয়ারিশ শাহ, বুল্লে শাহ ও সুলতান বাহুর মাজার থেকে সম্মানসূচক চাদর পাঠান তখন তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্তব্য করেন ‘অনেকদিন পর আমার মাতৃভূমি আমাকে স্মরণ করেছে।’
তাঁর অসাধারণ সব কবিতা, উপন্যাস ও গল্পের পাশাপাশি অমৃতা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন পাঞ্জাবি ভাষার লোকগানের অনন্য সংগ্রহের জন্যও। অক্টোবর ৩১, বহুমাত্রিক অনন্য এই কবির মৃত্যুবার্ষিকী। এই সামান্য অক্ষম অনুবাদ তাঁর প্রতি নিবেদিত। ইংরেজি শিরোনাম রাখা হয়েছে, মূলটা চাইলেই যে- কেউ যেন পাঠ করে নিতে পারেন।

আমি (গব)

অনেক অনেক সমসাময়িক
কিন্তু ‘আমি’ আমার সমসাময়িক নই।

আমার জন্ম ‘আমি’ ছাড়া
ভিক্ষার থালায় যেন এক কলঙ্কিত নৈবেদ্য।
কামনার একটি মুহূর্ত, মাংসেই সীমাবদ্ধ।

এবং যখনই এই মাংসের জিহ্ববা থেকে
শব্দেরা বেরিয়ে আসে, এটি নিজেকেই হত্যা করে।
আর যদিওবা নিজেকে হত্যা করা থেকে বাঁচিয়েও দেয়,
সেই শব্দরা প্রকাশিত হয় কাগজে, আর ঘটিয়ে দেয় অনিবার্য হত্যাকান্ড।

কামানের গোলা …
যদি আমাকে একবার আঘাত করে হ্যানয়ে
এটি আমাকে আবারো আঘাত করে প্রাগে।

একটি ছোট্ট ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে উঠে,
এবং আমার ‘আমি’ মরে যায় আট-মাসের শিশুর মতো।
আমার এই ‘আমি’ কি কোনদিনই হবে না আমার সমসাময়িক?

আমার ঠিকানা (গু অফফৎবংং)

আজ
আমি আমার বাড়ির নাম্বার মুছে দিয়েছি,
আর মুছে দিয়েছি রাস্তার মাথায় লাগানো রাস্তার নামটাও
আরও মুছে দিয়েছি আজ
আমার ঠিকানায় আসতে পারে এমন সমস্ত রাস্তার নির্দেশনাও

কিন্তু যদি তুমি সত্যিই আমাকে খুঁজে পেতে চাও
তাহলে করাঘাত কর
প্রতিটি দেশের প্রতিটি শহরের
প্রতিটি দরোজায়

এটি একটি অভিশাপ, আবার আশীর্বাদও

এবং যদি কোথাও
কোন মুক্ত মনের দেখা পাও
জেনে নিও ওটাই আমার বাড়ি

মানুষ (ঞযব গধহ)

আমি বেশ অর্জন করেছি
আর খরচও করেছি এর চেয়ে ঢের বেশি,
আর যা বাকি আছে
তাই আমার পুঁজি ;
এক সিকি হিটলার
এক সিকি যীশু
এক সিকি মনু
আর এক সিকি মনজু

আজ নয় (ঘড়ঃ ঞড়ফধু)

আমি সবসময় ঠিক কাজটিই করি
কিন্তু আজ নয়,
আমি সবসময় লোকেরা যা বলে তাই করি
কিন্তু আজ নয়
না!
নীল চাঁদের উপত্যকায়
যেখানে কিছুই বুড়ো হয় না
কিছুই পরিবর্তন হয় না
নির্ভুল
অন্ধকার
নির্ঝঞ্জাট
আমার উত্তপ্ত শিরায় শিরায় বিদ্রোহী রক্ত
আমি একটি ঝড় দেখতে চাই
আমার রক্তের মতোই প্রচন্ড
আমি দেখতে চাই মেঘেরা
চূর্ন করে দিচ্ছে
দৈত্যাকার পাথর
আর বিশাল সব পাহাড়ের শীর্ষ
এবং আমি আরো দেখতে চাই পাপের সমুদ্রের মত
গভীর সমুদ্র
আমি দেখতে চাই মেঘেরা
পতিত হচ্ছে ঐ পাপের সমুদ্রে
ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ
আমি পছন্দ করি না সুনীল আকাশ,
আমি সবসময় ঠিক কাজটিই করি
কিন্তু আজ আর নয়।

আমি জানি সমাজের রয়েছে বেশ জোরালো মত
কিন্তু আমার পকেটও বেশ ভারী
তাই ওসব জোরালো মত
আমি অনায়াসে কিনে নিতে পারি :

আমি জানি বেশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে ধর্ম
আর এও জানি ক্ষণিকের জন্য মাথা নোয়ালেই
তুষ্ট হয়ে যাবে ধর্ম ।

আমি জানি কিছু একটা চিৎকার করে উঠবে
আমার আত্মার ভেতর
আর মনোবিদ্যা এর কোন একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে
ঠিকই শান্ত করে রাখবে আমার বিদ্রোহী আত্মাকে ।

আমি সবসময় ঠিক কাজটিই করি
কিন্তু না, আজ আর নয়।

একটি দলিল (অ উড়পঁসবহঃ)

এই পৃথিবী
সূর্য ও চন্দ্রের মলাটে বাঁধানো
এক সুন্দর বই।
কিন্তু ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা এবং দাসপ্রথা
হে খোদা, এসব কি তোমারই বাণী
নাকি এই বইয়ে এসব
শুধুই ছাপার ভুল?

পূর্ববর্তী নিবন্ধআরকান-রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য
পরবর্তী নিবন্ধকলকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান