অভিযানের মাঝেও থেমে নেই মোটরসাইকেল চুরি

নানা গ্রুপ, নিত্যনতুন কৌশল

ঋত্বিক নয়ন | রবিবার , ৭ মে, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

নগরজুড়ে মোটরসাইকেল চুরি ঠেকাতে চলছে অভিযান। এরই ফাঁক গলে প্রতিদিন ৩/৪টি মোটরসাইকেল চুরি হচ্ছে। মোটরসাইকেল চুরিতে একটি গ্রুপের কৌশলের সাথে অন্যটির মিল থাকে না। সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই মিনিটে একেকটি মোটরসাইকেল চুরি করছে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তারকৃত মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যরা এ তথ্য দিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারাও বিষয়টি অস্বীকার করেননি। চক্রের সদস্যরা সুশৃঙ্খল। প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা আছে। মোটরসাইকেল চুরি করা থেকে বিক্রি করা পর্যন্ত পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে তারা এ কাজ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্যমতে, বর্তমানে মোটরসাইকেল চুরিতে একেকটি গ্রুপ তাদের সুবিধামতো পদ্ধতি প্রয়োগ করে। যেমন একটি গ্রুপ মোটরসাইকেলে নগরীতে ঘুরে বেড়ায় এবং বিভিন্ন আরোহীকে অনুসরণ করে। মোটরসাইকেল থেকে নামার পর তাদের একজন ওই আরোহীর পিছু নেয়। অপরজন রাস্তায় বা পার্কিং করে রাখা মোটরসাইকেলের ওপর বসে পত্রিকা পড়ার ভান করে তাদের কাছে থাকা বিশেষ চাবি দিয়ে সেটির লক খোলার চেষ্টা করে। লক খোলা সম্ভব হলে সেটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর অপর সহযোগী এসে তার মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। চোরেরা মোটরসাইকেলগুলোর নম্বর প্লেটের নম্বর ঢেকে প্রেস, সাংবাদিক, আইনজীবী, সিটি কর্পোরেশন কিংবা সিডিএ, পিডিবি, ওয়াসার স্টিকার লাগিয়ে দেয় বা রং দিয়ে লিখে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুরির আগে তারা সুযোগমতো ওই মোটরসাইকেলটির লক পরখ করে দেখে।

আবার অন্য গ্রুপ রাস্তায় ঘোরাফেরা করার সময় সুবিধাজনক কোনো স্থানে মোটরসাইকেল দেখলে চাপ দিয়ে স্টিয়ারিং ভেঙে ফেলে। সেখান থেকে বের হওয়া তার দিয়ে তা চালু করে চালিয়ে চলে যায়। এভাবে একটি মোটরসাইকেল চুরি করতে তাদের মাত্র দেড় থেকে দুই মিনিট সময় লাগে। চোরের দল মোটরসাইকেল চুরিতে সব সময় নতুনগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিক্রির সময় তারা জানায়, ভারত থেকে চোরাই পথে এনেছে বলে দাম কম। কাগজপত্র নিজেদের করে নিতে হবে। মোটরসাইকেলটি চোরাই বলে লাভের লোভে পার্টি গোপনে কিনে নেয়।

গত ১ মে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ যুবককে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুরিশ (ডিবি)। এই যুবকেরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে চোরাই মোটরসাইকেল বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) তাইয়ান আদনান নিহাদ জানান, গ্রেপ্তারকৃত মাজেদ উদ্দিন নাদিমের ফেসবুকে ‘এন কে মোটরস’ ও ‘অভ্রনীল নাদিম’ নামে আলাদা দুটি পেইজ আছে। এসব পেইজে পাঠাওয়ের মাধ্যমে চালানোর কথা বলে মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। সেই বিজ্ঞাপন দেখে কেউ কেউ তার নিজস্ব মোটরসাইকেল নাদিমকে ভাড়া দিত। কয়েকটি মোটরসাইকেল নেয়ার পর নাদিম সেখান থেকে দুয়েকটি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দিত। নগরীর বিভিন্ন থানায় এই প্রক্রিয়ায় মোটরসাইকেল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তিনটি মামলা আছে। আবার চুরি করা মোটরসাইকেলও তারা সংগ্রহ করত। সেই মোটরসাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো ফেসবুকের পেইজগুলোতে। পরে সেগুলো চোরাই বাজারে বিক্রি করত। নাদিমের নামে ফেসবুকের পেইজ খোলা হলেও ছয় জনের পুরো চক্রটিই এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। অভিযানে ১০টি চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।

গত মার্চ মাসে এ ধরনের একটি চক্রের দুই সদস্যকে চোরাই মোটরসাইকেলসহ গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্যমতে সন্দ্বীপে গিয়ে ২৩টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার করেছে আরও তিনজনকে। এ চক্রটি গত কয়েক বছরে এত বেশি মোটরসাইকেল চুরি করেছে যে তারা সঠিক হিসাব দিতে পারেনি পুলিশের কাছে। গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে মিঠুন ও খোরশেদ মোটরসাইকেল চুরি করে। অন্যরা কম দামে তা কিনে বেশি দামে বিক্রি করে।

সিএমপির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সম্প্রতি নগরী ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। যেগুলোর বিষয়ে বিভিন্ন থানায় মামলাও হয়েছে। মোটরসাইকেল চুরির বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ মিঠুন ধরের সন্ধান পায়। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে এ চক্রের অন্য সদস্যদের সন্ধান মেলে।

অভিযানে থাকা কোতোয়ালী থানার এসআই মোমিনুল হাসান জানান, সন্দ্বীপে আমরা যদি সপ্তাহব্যাপী অভিযান চালাতে পারতাম তবে শতাধিক চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা যেত। তিনি বলেন, এ চক্রের সদস্য মিঠুন ও খোরশেদ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সুবিধাজনক স্থানে তালা ছাড়া মোটরসাইকেল দেখলে সুযোগ বুঝে চালিয়ে চলে যায়।

মিঠুন পুলিশকে জানিয়েছে, যেসব মোটরসাইকেল তারা চুরি করে, সেগুলো বাবরের কাছে ১০/১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। হাতবদল হয় মূলত পুরাতন স্টেশন ও ফৌজদারহাট টোল রোড এলাকায়। বাবর ওইসব মোটরসাইকেল কুমিরা অথবা বাঁশবাড়িয়া ঘাট দিয়ে ট্রলারে করে সন্দ্বীপ নিয়ে শাহেদ, রিপনসহ আরো কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এর আগেও মিঠুন ও বাবর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি চক্রের নগরী থেকে অন্য একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মাত্র ৫ মিনিটেই মোটরসাইকেল চুরি করে হাওয়া হয়ে যেত। তাদের চুরির কবল থেকে রেহায় পায়নি পুলিশের গাড়িও। কারারক্ষী, সার্জেন্ট, মেডিকেল প্রমোশন অফিসারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় তদন্তে নামে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। মো. আনোয়ার হোসেন ও মো. সাজ্জাদ নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেয়া তথ্যে কঙবাজার জেলার রামু থানাধীন বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. ইউসুপকে (মেকানিক) আটক করা হয়। ইউসুপের দেয়া তথ্যে টেকনাফ থেকে চোর চক্রের সদস্য জাহিদুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। তাদের থেকে ৭টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।

সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত নগরীতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শতাধিক মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে ভুক্তভোগীদের ধারণা। অভিযোগ রয়েছে, মোটরসাইকেল চুরি হওয়ার পর থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ চুরি সম্পর্কিত জিডি নেয় না। ‘হারানো গেছে’ লিখলে নিমরাজি হয়ে জিডি নেয়া হয়।

কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কোতোয়ালী থানার ওসি মো. জাহিদুল কবীর। তিনি আজাদীকে বলেন, মোটরসাইকেল হারানো বা চুরি যাওয়ার পর মোটরসাইকেলের মালিক পুলিশকে অবহিত না করে নিজের মতো খুঁজতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ করে। এতে চোর মোটরসাইকেল নিয়ে নগরীর বাইরে চলে যায়। তিনি বলেন, অন্য থানার বিষয় আমি বলতে পারব না। তবে আমাদের এখানে কেউ মোটরসাইকেল চুরি সংক্রান্ত অভিযোগ করতে এলে আমরা উল্টো তাদের মামলা করার জন্য পরামর্শ দিই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৌদি সফরের জন্য ক্ষমা চাইলেন মেসি
পরবর্তী নিবন্ধরূপপুরের মেশিনারি নিয়ে মোংলা বন্দরে বিদেশি জাহাজ