অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক উন্নয়ন

| রবিবার , ১৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবিক উন্নয়ন সূচকে টেকসই ক্রমোন্নতিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। তাঁরা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গতিশীল নেতৃত্বে বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে একটি একীভূত, ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাত মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপগুলোর অন্যতম হলো- দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা সহজলভ্য করা এবং সকলের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।’
সরকারের নীতি হচ্ছে- ‘সমগ্র সমাজ দৃষ্টিভঙ্গি’ গ্রহণ, যাতে কেউ পেছনে পড়ে না থাকে, সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা অর্জন। নারী ও যুবদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান যাতে তারা দেশের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে পারে। বয়স্ক, বিধবা ও নির্ভরশীল পিতামাতাকে সম-পরিচর্যা সুবিধা প্রদান, জাতীয়ভাবে পরিবার-কেন্দ্রিক নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন ও শক্তিশালীকরণ, ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সকলের- বিশেষ করে নারীদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত, নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং সকলক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা আনতে নারী ও পুরুষের কাজে সমমর্যাদা ও সম-মজুরি নিশ্চিত করা।
এই উন্নয়ন দুধরনের। এক. বস্তুগত উন্নয়ন এবং দুই. সামাজিক উন্নয়ন। গাজী মিজানুর রহমান তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, আমাদের দেশে যথেষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কর্ণফুলী টানেল এর অন্যতম। কিন্তু সামাজিক উন্নয়ন বস্তুগত উন্নয়নের সঙ্গে হাত ধরে চলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী-শিশুর উন্নয়ন, যুবসমাজের উন্নয়ন, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা এসব ক্ষেত্রে এখনও আমরা পেছনে পড়ে আছি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এসব সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা দরকার হয়। ঠিকাদারের চেয়ে কর্মী বাহিনীর গুরুত্ব এখানে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছাপ আজ সহজেই বোঝা যায়। রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে ও বাড়ছেই, ঝকমকে বিপণিবিতানের সংখ্যা রাজধানী ছাড়িয়ে অন্যান্য শহরেও বাড়ছে, নানা ধরনের অভিজাত খাবারের দোকান যেমন, তেমনি তাতে খদ্দেরের ভিড়ও বেড়ে চলেছে। উচ্চশিক্ষাঙ্গনেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। বেকারত্ব বাড়লেও সেই সব তরুণের বড় একটি অংশ রোজগার ও ব্যয় করছে। বলা বাহুল্য তারা প্রধানত সরকারি দলের পরিচয়ে অবৈধ রোজগারে লিপ্ত হচ্ছে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায়, প্রায়ই স্থানীয় থানা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায়, ছোট ছোট দল সারা দেশেই অবৈধ রোজগার করছে। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা বস্তুগত উন্নয়নের তুলনায় সামাজিক উন্নয়নের দিক থেকে আমরা কতটা এগিয়ে, তার বিশ্লেষণ দরকার।
আবুল মোমেনও তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, দেশে ও সমাজে রুচির সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মানবিক বোধের নিঃস্বতা প্রকট হয়ে উঠছে। আয়, আয়ু, ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনে গতি, চাকচিক্য, জৌলুশ বৃদ্ধি এবং জাগতিক বৈষয়িক সাফল্য সত্ত্বেও সমাজ কিন্তু মানবিক মানদণ্ডে হেরে যাচ্ছে। সমাজে চোখ রাখলে এবং কান পাতলে সব ধরনের মানুষের মধ্যে হতাশা, অস্থিরতা, অস্বস্তির নানা অভিব্যক্তিই ধরা পড়বে। বাংলাদেশে আজ নিরাপত্তা প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ বাঙালি আজ আদিম জিঘাংসা বৃত্তিতে বদলা নেওয়ার (হত্যার বদলে হত্যা) সংস্কৃতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে।
আজকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য হলো এত উন্নয়ন ও চাকচিক্য, এত ভোগবিলাস ও আড়ম্বরের মধ্যেও বাংলাদেশের সমাজজীবন প্রাণশক্তি হারাচ্ছে। ব্যক্তিগত অর্জন কিছু কিছু ঘটছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজটা মনে ও প্রাণে হেরে যাচ্ছে। কারণ, সংস্কৃতিচর্চাহীন সমাজ কখনো উন্নত ও প্রাণবন্ত হতে পারবে না।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সামাজিক জীবনে পতনের অর্থ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও সদিচ্ছার অভাব। যখন মানুষের সুবুদ্ধি ও সদিচ্ছা দুর্বল হয়, তখনই সে মন্দের প্রতি ধাবিত হয়। যা সমাজজীবনকে নষ্ট করে, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে বস্তুগত ও আত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে; বরং যখন কোনো মন্দ বিষয় কোনো জাতির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসের কারণ হয়।
তাই বলা যায়, অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা বিফলে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে