আমরা জেনে বিস্মিত যে, চট্টগ্রামের প্রায় দুই কোটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ চট্টগ্রামে নেই। ক্যান্সার আক্রান্ত এখানকার হাজার হাজার মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুর্ভোগ সইতে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য ও সুযোগ আছে তাঁরা লাখ বা কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যাঁরা গরিব অসচ্ছল ক্যান্সার রোগী তাঁরা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছেন বা মারা যাচ্ছেন চিকিৎসার সুযোগের অভাবে। ক্যান্সারের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করতে গিয়ে বহু পরিবারই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সচ্ছলতা হারিয়ে এদের অনেকে আজ কোরবানি করতে পারছেন না। এসব তথ্য আমরা জানতে পেরেছি চট্টগ্রামের পাঠকধন্য দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ঈগঙঝঐ ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
দৈনিক আজাদীর প্রথম ও শেষ পাতায় কয়েকদিন ধরে প্রকাশিত ‘কোরবানির পশু কেনার টাকা সাশ্রয় করে ক্যান্সার হাসপাতালে সহযোগিতা করুন’ শীর্ষক এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিত্তবান কোরবানিদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ঈগঙঝঐ ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং মেম্বার সেক্রেটারি মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদ।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল একটি বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে কয়েক বছর আগে। এই হাসপাতাল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৭০ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে দশ কাঠা জায়গার ওপর ৮০ হাজার বর্গফুটের ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন মেশিন আমদানি করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে আরো বহু টাকা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম তথা দেশের বহু শিল্প গ্রুপ, নানা প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান ব্যক্তিরা ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য কোটি কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। অনেকেই অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। আশা করা যায় খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হবে।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা এখন দোরগোড়ায়। ধর্মপ্রাণ বিত্তবান মুসলমানরা এখন কোরবানির পশু কেনাকাটায় ব্যস্ত। অনেক বিত্তবান লাখ লাখ টাকা দামের পশু কোরবানি দেন। কে কতো বেশি টাকা দামের কোরবানির পশু কিনবেন এ নিয়ে যেন বিত্তবানদের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে যতো বেশি টাকা দিয়ে পশু কিনেন, সমাজে তার সম্মান ও কদরও যেন থাকে তুঙ্গে। অথচ, কোরবানি হচ্ছে একটি ইসলামী রুসম, প্রথা বা বিধান। আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই কোরবানি দিতে হয়। এখানে বিত্ত বা টাকার বাহাদুরি প্রদর্শনের কিছু নেই। পঞ্চাশ ষাট হাজার বা লাখ দেড় লাখ টাকা দিয়েও পশু কেনা যায়। পশু কেনার খরচ সাশ্রয় করে চারপাশের গরিব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। এই যে চট্টগ্রামে একটি বড় ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে উঠছে বেসরকারি উদ্যোগে, বিত্তবানরা এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন। অনাবশ্যক খরচ বাঁচিয়ে কিংবা কোরবানির পশু কেনার টাকা থেকে কিছু টাকা সাশ্রয় করে বিত্তবানরা যদি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন–তাই হবে একটি বড় মহৎ কাজ। মানবিক কাজ। ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে তাতে শুধু মানবিক কাজই পালন করা হবে তাই নয় পাশাপাশি মহান আল্লাহ পাকও নিশ্চয়ই খুশি ও সন্তুষ্ট হবেন। কেননা, আর্ত মানবতার সেবাই তো বড় ইবাদত। মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি চাইলে আর্ত দুস্থ পীড়িত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা উচিত এটা যেন বিত্তবানরা ভুলে না যান।
কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদার ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলছেন-‘আল্লাহর নিকট তোমাদের কোরবানির মাংস রক্ত কিছুই পৌঁছে না, কিন্তু তোমাদের তাকওয়াই (হৃদয়ের অভিব্যক্তি) তাঁর নিকট পৌঁছে।’ কোরবানিদাতাদেরকে এই দিকটি লক্ষ্য রাখা উচিত। কোরবানির পশু কেনার দৌড়ে বা প্রতিযোগিতায় নিজেদের সঁপে না দিয়ে কীভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোরবানির পশুর মাংস একাই ভক্ষণ না করে বাড়ির আঙ্গিনায় জড়ো হওয়া গরিব নিঃস্ব অভাবগ্রস্তদের মাঝে বণ্টন করে দিন। মাংস ফ্রিজে রাখুন আপত্তি নেই, কিন্তু গরিবদের বঞ্চিত করে সব মাংস একাই রেখে দেওয়া অমানবিকতা ছাড়া কিছু নয়।
অপ্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে বা কোরবানির পশুর টাকা থেকে কিছুটা সাশ্রয় করে গরিব দুস্থ পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই কথা দুই বছর আগে দৈনিক আজাদীতে কলাম লিখে সর্বপ্রথম আহ্বান জানিয়ে ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সংবাদ ব্যক্তিত্ব দৈনিক আজাদী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এম এ মালেক। অনেকের মনের কথাই আজাদীতে কলাম লিখে তিনি প্রকাশ করেছেন। কোনো কারিগরি প্রতিষ্ঠানে, এতিমখানায় বা হাসপাতালের জন্য দান অনুদানের হাত প্রসারিত করার কথা জোরালোভাবে তিনি বারবার বলে আসছেন নানা সভা সম্মেলনে কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে। তাঁর এই বক্তব্য ও আহ্বান নিশ্চয়ই সময়োপযোগী, যুক্তিগ্রাহ্য ও সুদূরপ্রসারী। তাঁর এই আহ্বানে ইসলামের নির্দেশনা ও মানবিক চেতনা খুঁজে পাওয়া যায়।
ঈগঙঝঐ ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দৈনিক আজাদীতে যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাও নিশ্চয়ই জনাব এম এ মালেকের নিজস্ব ভাবনা, ব্যতিক্রমী ধ্যান ধারণা থেকে উঠে এসেছে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। জনাব এম এ মালেক শুধুমাত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক হিসেবে সমাজসেবা ও জনকল্যাণে নিবেদিত তাই নন, তিনি বহু নিত্য নতুন চিন্তাভাবনা, ধ্যান–ধারণা এবং নতুন নতুন গণমুখী উদ্ভাবনার জন্যও চট্টগ্রাম তথা দেশবাসীর কাছে আজ নন্দিত। দুই বছর আগে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘আপনারা যারা কোরবানি করবেন’ শীর্ষক কলাম লিখে কোরবানির পশু কেনার খরচ কিছুটা বাঁচিয়ে তা মানবিক কাজে ব্যয় করার যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন তা আজ সবার মনের কথাই হয়ে উঠেছে। তাই আসুন, আমরা অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য খরচ বাঁচিয়ে চারপাশের অসহায় দুস্থ পীড়িত গরিব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াই। চট্টগ্রামে যে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার হাসপাতাল জনাব এম এ মালেকদের সহায়তায় গড়ে উঠছে, তাতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমরা যেন ভূমিকা রাখি। আসুন, ত্যাগী ও মানবিক হই। আর্ত দুস্থ পীড়িতদের সেবায় আমরা যেন উৎসর্গীত হই–এই হোক আমাদের প্রত্যয়।
লেখক : সাংবাদিক