অপরিণত শিশুর চিকিৎসায় ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার যে কারণে জরুরি

বিশ্ব প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

আজ (১৭ নভেম্বর) বিশ্ব প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস। বিশ্বের ১৯৬টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। সারা দেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মা-বাবার সান্নিধ্যই একজন প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্য শক্তিশালী থেরাপি।’ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতালও দিবসটি পালন করছে।
সাধারণত একজন নবজাতক ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন মায়ের গর্ভে থাকার পর জন্মগ্রহণ করে। এসময় একটি শিশু পৃথিবীতে এসে বেঁচে থাকার মতো পরিপক্কতা ও শক্তি অর্জন করে। কিন্তু কখনো কখনো নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশু জন্ম নেয়। সাধারণত ৩৭ সপ্তাহ বা ২৫৯ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রি-ম্যাচিউর (অপরিণত) শিশু বলা হয়ে থাকে। আর প্রি-ম্যাচিউর শিশুর অধিকাংশই জন্ম নেয় স্বল্প ওজনে। সাধারণত একটি নবজাতকের ওজন আড়াই কেজি বা আড়াই হাজার গ্রাম। কখনো এর চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রি-ম্যাচিউর শিশুর ওজন এর কম থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিউমোনিয়ার পর পৃথিবীজুড়ে নবজাতক-মৃত্যুর বড় একটি কারণ এই প্রি-ম্যাচিউর বার্থ বা নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম। মোট শিশু মৃত্যুর ৩০ শতাংশই মারা যায় এই প্রি-ম্যাচিউরিটির কারণে। আর অপরিণত হিসেবে জন্ম নেয়া যেসব শিশু বেঁচে থাকে, তারাও পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতায় ভোগে। বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৫০ লাখ নবজাতক ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম নেয়। অর্থাৎ প্রতি ১০টি শিশুর একটি প্রি-ম্যাচিউর (অপরিণত) হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা আরো বেশি (প্রায় দ্বিগুণ)। প্রতি একশ নবজাতকের মধ্যে ১৪ জন শিশু প্রি-ম্যাচিউর বা অপরিণত হিসেবে জন্ম নেয় বাংলাদেশে।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস ঘিরে চট্টগ্রামে প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্ম-চিকিৎসা সুবিধাসহ সার্বিক দিক নিয়ে দৈনিক আজাদীর সাথে কথা বলেছেন এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতালের
শিশু ও নবজাতক বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান ডা. ফয়সল আহমদ।
প্রি-ম্যাচিউর দিবস পালনের গুরুত্ব/তাৎপর্য সম্পর্কে ডা. ফয়সল আহমদ বলেন, প্রতিটি দিবস পালিত হয় কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। প্রতিদিন প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্মের হার বেড়েই চলেছে। যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। সচেতনতা, সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংকটকে যৌক্তিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। মূলত সচেতনতা সৃষ্টি ও দায়িত্ববোধ তৈরির উদ্দেশ্যেই দিবসটি পালন করা হয়। এটি অনেকটা সামাজিক আন্দোলনের মতো, যেখানে সবারই দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারের সদস্য, ডাক্তার-নার্র্স, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে।
দিবসটির এবছরের প্রতিপাদ্য নিয়ে ডা. ফয়সল বলেন, প্রি-ম্যাচিউর দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘মা-বাবার সান্নিধ্যই একজন প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্য শক্তিশালী থেরাপি।’ একজন প্রি-ম্যাচিউর নবজাতককে জন্মের পর যত দ্রুত সম্ভব তার মা-বাবার কোলে তুলে দেয়ার গুরুত্ব তুলে ধরাই এবারের প্রতিপাদ্যের মূল বিষয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রি-ম্যাচিউর শিশুকে দ্রুত মায়ের সান্নিধ্যে দিতে পারলে শিশুটি দ্রুত সুস্থতা লাভ করে।
মা-বাবার সান্নিধ্য বুঝাতে গিয়ে ডা. ফয়সল বলেন, জন্মের পরপরই নবজাতককে মায়ের কোলে দেয়াটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। যাকে চিকিৎসকের ভাষায় ‘স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট’ বলা হয়ে থাকে। যা শিশুর শরীরের তাপমাত্রা, নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এই ব্যবস্থাকে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) বলা হয়। যেখানে মা ও নবজাতক দুজন একসাথে থেকে চিকিৎসা নিতে পারে। কেএমসি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ক্যাঙ্গারু যেভাবে তার পেটের থলিতে নিজের বাচ্চাকে ধারণ করে, অনেকটা সেভাবেই নবজাতককে মা তার শরীরের সাথে জড়িয়ে রেখে খাওয়ানো থেকে শুরু করে অন্যান্য চিকিৎসা সেবা নিতে পারে। এর মাধ্যমে নবজাতক দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে। মায়ের কাছ থেকে নবজাতককে আলাদা করা কখনই মা ও নবজাতকের জন্য কল্যাণকর নয়। তাই প্রতিটি হাসপাতালে মা ও নবজাতককে একত্রে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা অর্থাৎ কেএমসি সুবিধা থাকা উচিত। অবশ্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে সরকারি সব হাসপাতালে কেএমসি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় এত বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও এক্ষেত্রে গিয়ে আসা উচিত। অবশ্য, এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতাল, চট্টগ্রামে এরইমধ্যে ৮ শয্যার কেএমসি ইউনিট চালু করা হয়েছে। যদিও এটি পর্যাপ্ত নয়। এর পরিধি আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
একজন অপরিণত নবজাতক বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে উল্লেখ করে ডা. ফয়সল আহমদ বলেন, নবজাতকটি কতটা অপরিণত, এর উপর জটিলতাগুলো নির্ভর করে। অপরিণত নবজাতকরা সাধারণত শ্বাস কষ্ট, রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, ইনফেকশান (সংক্রমণ), ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, খেতে না পারা বা খাওয়ার পর পেট ফুলে যাওয়া প্রভৃতি জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এসব জটিলতা জন্মের পরপরই দেখা দেয়। আর পরবর্তীতে চোখের সমস্যা, শ্রবণ জটিলতা ও বেড়ে উঠায় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে।
অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন, একজন প্রি-ম্যাচিউর শিশুর চিকিৎসার বিষয়টি অনেক ব্যাপক। বিশেষভাবে এটি নির্ভর করে ওই নবজাতক কতখানি অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছে এবং ঠিক কি অবস্থায় পাওয়া গেছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- কোনো অপরিণত নবজাতককে যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেন্টারে (হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থেকে শিশুকে সারিয়ে তোলার সুযোগ থাকে।
যেমন- শ্বাস কষ্টের জটিলতায় ভোগা অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা খুব দ্রুত শুরু করতে হয়। এর জন্য কিছু আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, অতি প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধের পাশাপাশি সেবাদানে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তার-নার্স প্রয়োজন। সব হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টারে এরকম সব ধরনের সুবিধা থাকে না। সরকারি পর্যায়ে এই ব্যবস্থা অপ্রতুল। আর বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। অনেক পরিবারের পক্ষে এই চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। কেবল সামর্থ্যের অভাবেই অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা চলাকালীন শিশুকে মাঝপথে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। যা ওই শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা ব্যয় যথাসাধ্য কমানোর মাধ্যমে এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো সুলভ ও রোগী বান্ধব করা উচিত। এখানে সমাজের বিত্তবানদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। প্রতিটি প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতে আরো বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
একজন প্রি-ম্যাচিউর শিশুকে আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে, এমন স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া জরুরি উল্লেখ করে ডা. ফয়সল বলেন, সব ধরনের সুবিধা নেই, এমন কোনো চিকিৎসা সেন্টারে এ ধরনের নবজাতককে নিয়ে যাওয়া হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে এ কারণেই অপরিণত নবজাতকের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের নবজাতকের চিকিৎসায় রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন উপাদানের (যেমন- প্লাজমা, আরবিসি, প্লাটিলেট প্রভৃতি) প্রয়োজন হয়। যা সঠিক নিয়মে স্ক্রিনিং পরবর্তী উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে নবজাতকের শরীরে দিতে হয়। তাছাড়া অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসায় একটি সমন্বিত এনআইসিইউ (নিউনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ও কেএমসি ইউনিট অপরিহার্য। যেসব হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টারে অপরিহার্য সবধরনের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দক্ষ ডাক্তার-নার্স রয়েছে, একজন অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসায় দেরি না করে সেখানেই নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। খুব ভালো হয়, সন্তান জন্মদানে (প্রসবের ক্ষেত্রে) সবধরনের সুবিধা থাকা হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টার বেছে নেয়া হলে। সেক্ষেত্রে নবজাতকের অবস্থা জটিল হলেও অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানির প্রয়োজন পড়বে না। নবজাতকটি যেন কম সময়ের মধ্যে ওই সেন্টারেই মানসম্মত চিকিৎসা সেবাটা পায়। এক্ষেত্রে গাইনি বা প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন।
এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতালে অপরিণত নবজাতকদের চিকিৎসা সুবিধার বিষয়ে ডা. ফয়সাল বলেন, যাত্রার শুরু থেকেই নবজাতকদের চিকিৎসায় একটি সমুন্নত ও আধুনিক সেন্টার করেছে এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতাল। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার ও দক্ষ নার্স দ্বারা পরিচালিত এবং উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত এ সেন্টারটি ইতোমধ্যে চিকিৎসক সমাজ ও সাধারণ রোগীদের আস্থা অর্জন করেছে। ক্রিটিক্যাল নিউ বর্ন বেবি পরিবহনে এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতালের লাইফসাপোর্টসহ এনআইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। যেটির সাহায্যে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে এ পর্যন্ত ৫ শতাধিক ক্রিটিক্যাল নিউ বর্ন বেবি এপোলো-ইমপেরিয়াল হাসপাতালের এনআইসিউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সকল প্রি-ম্যাচিউর শিশু যাতে যথাযথ চিকিৎসা পায়, সে প্রত্যাশা করেন ডা. ফয়সল আহমদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধগুমাই বিলে ধান কাটা শুরু