অপরিণত নবজাতককে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেন্টারে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্ব প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস আজ ।। আজাদীকে ডা. ফয়সাল আহমেদ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস আজ। বিশ্বের ১৯৬টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। সারা দেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মা আর নবজাতককে আলাদা করা যাবে না, যত দ্রুত সম্ভব তাদের একত্রিত করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে’। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ইমপেরিয়াল হাসপাতালও দিবসটি পালন করছে।
সাধারণত একজন নবজাতক ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন মায়ের গর্ভে থাকার পর জন্মগ্রহণ করে। এ সময় একটি শিশু পৃথিবীতে এসে বেঁচে থাকার মতো পরিপক্বতা ও শক্তি অর্জন করে। কিন্তু কখনো কখনো নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশু জন্ম নেয়। সাধারণত ৩৭ সপ্তাহ বা ২৫৯ দিন পূর্ণ হওয়ার আগে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রি-ম্যাচিউর (অপরিণত) শিশু বলা হয়। আর প্রি-ম্যাচিউর শিশুর অধিকাংশই জন্ম নেয় স্বল্প ওজনে। সাধারণত একটি নবজাতকের ওজন আড়াই কেজি। কখনো এর চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রি-ম্যাচিউর শিশুর ওজন এর কম থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিউমোনিয়ার পর পৃথিবীজুড়ে নবজাতক মৃত্যুর বড় একটি কারণ প্রি-ম্যাচিউর বার্থ বা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিশুর জন্ম। মোট শিশু মৃত্যুর ৩০ শতাংশই মারা যায় প্রি-ম্যাচিউরিটির কারণে। অপরিণত হিসেবে জন্ম নেয়া যেসব শিশু বেঁচে থাকে, তারাও পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতায় ভোগে। বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি বছর এক কোটি ৫০ লাখ নবজাতক ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম নেয়। অর্থাৎ প্রতি ১০টি শিশুর একটি প্রি-ম্যাচিউর হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। বাংলাদেশে প্রতি একশ নবজাতকের মধ্যে ১৪ জন শিশু প্রি-ম্যাচিউর হিসেবে জন্ম নেয়। এমন প্রেক্ষাপটে প্রি-ম্যাচিউরিটি দিবস ঘিরে চট্টগ্রামে প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্ম, চিকিৎসা সুবিধাসহ সার্বিক দিক নিয়ে দৈনিক আজাদীর সাথে কথা বলেছেন ইমপেরিয়াল হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ ও এনআইসিইউর কনসালটেন্ট ডা. ফয়সাল আহমেদ।
আজাদী : প্রি-ম্যাচিউর দিবসের গুরুত্ব/তাৎপর্য সম্পর্কে বলুন।
ডা. ফয়সাল আহমেদ : প্রতিটি দিবস পালিত হয় কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের অনেক ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো কোনো শিশুকে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়। এসব শিশুর স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং এর সাথে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পৃক্ততাকে নজরে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই দিবসটি পালন করা হয়। একজন অপরিণত নবজাতকেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আর এ দায়িত্ব শুধু বাবা-মায়ের নয়, সমাজ বা রাষ্ট্রকেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
আজাদী : একজন অপরিণত নবজাতক কি কি জটিলতার সম্মুখীন হয়?
ডা. ফয়সাল : নবজাতকটি কতটা অপরিণত, এর ওপর জটিলতাগুলো নির্ভর করে। অপরিণত নবজাতকরা সাধারণত শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, ইনফেকশন (সংক্রমণ), ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, খেতে না পারা বা খাওয়ার পর পেট ফুলে যাওয়া প্রভৃতি জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এসব জটিলতা জন্মের পরপরই দেখা দেয়। আর পরবর্তীতে চোখের সমস্যা, শ্রবণ জটিলতা ও বেড়ে ওঠায় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
আজাদী : এ ধরনের জটিলতা থেকে একজন নবজাতককে কীভাবে সারিয়ে তোলা যায়?
ডা. ফয়সাল : এ প্রশ্নের উত্তর অনেক ব্যাপক। বিশেষভাবে এটি নির্ভর করে ওই নবজাতক কতখানি অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছে এবং ঠিক কী অবস্থায় পাওয়া গেছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনো অপরিণত নবজাতককে যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেন্টারে (হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থেকে শিশুকে সারিয়ে তোলার সুযোগ থাকে। যেমন শ্বাসকষ্টের জটিলতায় ভোগা অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা খুব দ্রুত শুরু করতে হয়। এর জন্য কিছু আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, অতি প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধের পাশাপাশি সেবাদানে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তার-নার্স প্রয়োজন। সব হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টারে এ রকম সব ধরনের সুবিধা থাকে না। সব ধরনের সুবিধা নেই, এমন কোনো চিকিৎসা সেন্টারে এ ধরনের নবজাতককে নিয়ে যাওয়া হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে এ কারণেই অপরিণত নবজাতকের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের নবজাতকের চিকিৎসায় রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন উপাদানের (যেমন প্লাজমা, আরবিসি, প্লাটিলেট) প্রয়োজন হয়। যা সঠিক নিয়মে স্ক্রিনিং পরবর্তী উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে নবজাতকের শরীরে দিতে হয়। তাছাড়া অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসায় একটি সমন্বিত এনআইসিইউ (নিউনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) অপরিহার্য। যেসব হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টারে অপরিহার্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দক্ষ ডাক্তার-নার্স রয়েছে, একজন অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসায় দেরি না করে সেখানেই নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। খুব ভালো হয়, সন্তান জন্মদানে সব ধরনের সুবিধা থাকা হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেন্টার বেছে নেয়া হলে। সেক্ষেত্রে নবজাতকের অবস্থা জটিল হলেও অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানির প্রয়োজন পড়বে না। নবজাতকটি যেন কম সময়ের মধ্যে ওই সেন্টারেই মানসম্মত চিকিৎসা সেবাটা পায়। এক্ষেত্রে গাইনী বা প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন।
আজাদী : অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা ব্যয় কেমন?
ডা. ফয়সাল : অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসাও তুলনামূলক ব্যয়বহুল। অনেক পরিবারের পক্ষে এই খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। কেবল সামর্থ্যের অভাবেই অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা চলাকালীন শিশুকে মাঝপথে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, যা ওই শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আজাদী : একজন নবজাতকের প্রি-ম্যাচিউর হিসেবে জন্মগ্রহণের ঝুঁকি বা কারণগুলো কী?
ডা. ফয়সাল : একটি নবজাতক অপরিণত হিসেবে জন্মগ্রহণের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মাঝে কিছু বিষয় মায়ের সাথে সম্পৃক্ত। আর কখনো কখনো নবজাতকই এর কারণ। আবার কিছু অজানা কারণও রয়েছে। মায়ের সাথে সম্পৃক্ত বেশ কিছু কারণে একটি শিশু প্রি-ম্যাচিউরড বা পরিপূর্ণ সময়ের আগেই জন্ম নিতে পারে। এসব কারণের মধ্যে মায়ের অপুষ্টিতে ভোগা এবং মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণ অন্যতম। এছাড়া মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, মায়ের দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ (কিডনি, অ্যাজমা, হার্ট) থাকা, মায়ের খিঁচুনি ও জরায়ুতে কোনো সমস্যা থাকলেও শিশু প্রি-ম্যাচিউরড ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। এক্ষেত্রেও গাইনী বা প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। তারাই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ প্রসূতি বা মায়েদের চিহ্নিত করতে পারেন। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত প্রসূতিদের ডেলিভারি বা সন্তান জন্মদানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন সঠিক চিকিৎসা সেন্টারে ভর্তির জন্য প্রসূতি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিতে পারেন। সেটি হলে ওই নবজাতকের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া প্রি-ম্যাচিউর নবজাতক জন্মদানের ঝুঁকি এড়াতে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেয়া ও গর্ভধারণ নিরুৎসাহিত করতে সমাজে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
আজাদী : প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে আপনার কী পরামর্শ?
ডা. ফয়সাল : অপরিণত নবজাতকদের সুচিকিৎসায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ পদক্ষেপগুলো সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে নেয়া যেতে পারে। যেমন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা। বিশেষ করে নার্সদের প্রশিক্ষিত করা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের স্কিল বাড়াতে ব্যবস্থা নেয়া, ডাক্তারদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষায়িত সেন্টার গড়ে তোলা। সরকারি উদ্যোগে উন্নত প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করা। বিশেষ কিছু ওষুধ (যেমন সারফেক্ট্যান্ট) সরবরাহ ও মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা। অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসায় সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেন্টার বা হাসপাতালে রেফার করা (এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ)। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একটি তহবিল গঠন করা যেতে পারে, যাতে অপরিণত সব নবজাতকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
আজাদী : ইমপেরিয়াল হাসপাতালে অপরিণত নবজাতকদের চিকিৎসা সুবিধার বিষয়ে বলুন।
ডা. ফয়সাল : যাত্রার শুরু থেকেই নবজাতকদের চিকিৎসায় একটি সমুন্নত ও আধুনিক সেন্টার করেছে ইমপেরিয়াল হাসপাতাল। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও দক্ষ নার্স দ্বারা পরিচালিত এবং উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত এ সেন্টারটি ইতোমধ্যে চিকিৎসক সমাজ ও সাধারণ রোগীদের আস্থা অর্জন করেছে। এই সেন্টারে আমরা আরো অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম যুক্ত করার পাশাপাশি নতুন কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি, যা অপরিণত নবজাতকদের সুচিকিৎসায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমাদের আশাবাদ।
আজাদী : আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. ফয়সাল : আপনাকে এবং দৈনিক আজাদীকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহাসড়কে প্রাণ গেল চাচা-ভাতিজার
পরবর্তী নিবন্ধস্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণে গতি