অপরাধী ৫০০ সোর্সের তালিকা পুলিশ সদর দপ্তরে

হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

অপরাধ দমনে ও অপরাধী ধরতে সোর্সদের ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী। এই পুরনো পদ্ধতি ছাড়াও বর্তমানে পুলিশ ডিজিটাল সোর্স ব্যবহার করছে। কিন্তু সোর্সমানি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংকটের কারণে পেশাদার সোর্সরা একে একে পেশা ছেড়ে দিচ্ছে আর উঠতি সোর্সরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে। সোর্সের সহযোগিতায় আসামি হয়তো ধরতে পারছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা, কিন্তু সোর্সদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় হিতে বিপরীত হচ্ছে তাদের। সোর্সের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের উপর নির্ভর করে অভিযান চালাতে গিয়ে নিরপরাধ অনেকের জেল জরিমানা সম্মানহানি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ করে মহানগরগুলোতে অন্তত ৫০০ সোর্স অপরাধে জড়িত, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এই দাগি সোর্সদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সব মহানগর পুলিশের কমিশনার ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে চিঠি পাঠিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর সোর্সদের লাগাম টানতে বলেছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পুুলিশের যারা সোর্স ব্যবহার করেন, তারা যেন তাদের আমলনামা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেন। এর ভিত্তিতে ৫০০ সোর্সের নাম পরিচয়সহ একটি তালিকা ইতোমধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তরে করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-মিডিয়া) হায়দার আলী খান বলেন, অপরাধী ধরতে সোর্সের প্রয়োজন রয়েছে। সোর্সের ব্যাপারটা সংশ্লিষ্ট অফিসারের উপর নির্ভর করে। এখন সোর্স যদি অফিসারকেই বিক্রি করে, তবে সে কীভাবে সোর্স হবে? সোর্সরা পুলিশের নাম ব্যবহার করে অপরাধ চালায় বলে আমরা প্রায়শই অভিযোগ পাচ্ছি। অপরাধ যারা করবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, যে লোকটা সোর্স হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে বেড়াবে, সে কখনোই সোর্স হতে পারে না। তবে ধীরে ধীরে পেশাদার সোর্সের প্রয়োজন কমছে। কমিউনিটি পুলিশিং, উঠান বৈঠকের কারণে সাধারণ মানুষ থেকে আমরা এখন অনেক তথ্য পাচ্ছি। সাধারণ মানুষ আইনশৃক্সখলা বাহিনীর কাজে যতো এগিয়ে আসবে সোর্স নামধারীদের দৌরাত্ম্য ততোই কমবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সোর্স জানান, বিভিন্ন থানা এলাকায় উপপরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপপরিদর্শকদের (এএসআই) পছন্দের সোর্স রয়েছে। রাতে দায়িত্ব পড়লে সোর্সদের ডেকে নেওয়া হয়। এরপর টার্গেট করে তারা মাঠে নামেন। রাত শেষে অবৈধ উপার্জনের ২৫ শতাংশ সোর্সরা ভাগ পান। মাসে অন্তত ১২ দিন রাতে তারা দায়িত্ব পালন করেন। ওই ১২ দিনই সোর্সরা উপার্জন করে সংসার চালান। আবার অনেক সোর্স মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতেও তারা পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে থাকেন।

অনুসন্ধানে জানা যায় সোর্স মানির বরাদ্দ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ আছে, কোনও কোনও জেলার পুলিশ সুপার সোর্স মানি কখনও জুনিয়রদের হাতে দেন না। নিজেই পুরো টাকা রেখে দেন। তবে পছন্দের কর্মকর্তাদের কিছু টাকা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ কর্মকর্তা এই টাকা পান না। সরকারি ‘সোর্স মানি’ না পেয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য থানার কর্মকর্তারা বিভিন্ন উপায়ে টাকা সংগ্রহ করেন।

চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার মাঠ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোর্স মানি থানা পর্যন্ত পৌঁছে না। পৌঁছলেও মাঠের অফিসাররা পান না। তবে মাঠ পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে থানায় যেত না সোর্স মানি। এখন টোকেন মানি হিসেবে কিছু হলেও আসে। তবে তা দিয়ে একটি থানায় পুলিশের এক দিনের খাওয়ার খরচও হয় না। বাধ্য হয়ে তাই উদ্ধারকৃত মাদকের একটি অংশ দিয়ে দিতে হয় সোর্সকে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মূলত মাঠ পর্যায়ে বেশি কাজ করেন সাব-ইন্সপেক্টররা। একজন ইন্সপেক্টর বা সাব-ইন্সপেক্টরের পেছনে রয়েছে ৩-৪ জন সোর্স। একজন সাব-ইন্সপেক্টর মাসে ন্যূনতম এক হাজার টাকা সোর্স মানি পাওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাচ্ছেন না তারা। ফলে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্য বা পণ্যের একটি অংশ থেকে ভাগ দিতে হয় সোর্সদের।

গত দু’দিন ধরে জেলার হাটহাজারী, পটিয়া ও সাতকানিয়া থানা, সিএমপির কোতোয়ালী, বায়েজিদ, আকবরশাহ, ইপিজেড, ডবলমুরিং ও বাকলিয়া থানা এবং নগর গোয়েন্দা শাখার একাধিক সাব ইন্সপেক্টরের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আজাদীর। প্রায় সকলেই অভিন্ন দাবি করে বলেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণবিহীন একটি মামলার তদন্ত শেষ করতে ব্যয় হয় হাজার হাজার টাকা। সরকারি কাজে নিজের পকেট থেকে কেন সোর্সদের টাকা দেয়া হবে? এমন প্রশ্নও তোলেন তারা। তারা জানান, সোর্স মানি নিয়ে নানা জটিলতার মধ্যেও মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করতেও চাপ থাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। সাথে নিজের পারফরমেন্স না দেখালে বদলির ভয় থাকে। এ অবস্থায় ‘সব দিক সামাল দিতে আটক মাদকের একটি অংশ বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প আর কিছুই নেই।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন ছোট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া দাগী আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষকে পুলিশ সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। তথ্যের বিনিময়ে এই সোর্সদের টাকা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত। পুলিশ সদর দফতর থেকে যখন এই টাকা দেওয়া হয়, তখন তা ‘অপারেশন মানি’ হিসেবে উল্লেখ থাকে।

পুলিশের সূত্র জানায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট অনেক উন্নত হয়েছে। অপহরণ, হত্যাকাণ্ড, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ এখন বিভিন্ন ডিজিটাল সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। যেকোন তথ্য-উপাত্ত ও আসামির অবস্থান শনাক্তের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। এভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অপরাধী ও আসামিকে গ্রেপ্তার করার নজির এখন অনেক বেশি। ডিজিটাল সোর্স হিসেবে পুলিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, গুগল ম্যাপ, মোবাইল ফোন ডিভাইস, কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিয়ার) এর সহযোগিতা নিয়ে থাকে। প্রযুক্তির ব্যবহার করলেও ক্লু-লেস মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ম্যানুয়েল সোর্সের বিকল্প এখনও নেই বলে জানিয়েছেন তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি বিজয় দেখেছি
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বকাপের ঝড়ে কাঁপলো