মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে নানা বিশেষণে অলঙ্কৃত করা হয় কিন্তু একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে তিনি যে এই ভারতবর্ষে একটা মাইলফলক রেখে গেছেন সে আলোচনা কম হয়েছে। অন্তঃপুরবাসিনী এক মুসলিম নারী তাঁর কল্পনাকে আদর্শের আবরণে মুড়ে দূরদর্শিতার যে কাজটা করেছিলেন তা’ বিশেষ ভাবনার দাবি রাখে।
সময়কাল ১৯০৫, যখন ভারতবর্ষের নারীরা বিশেষ করে মুসলিম নারীরা আড়ালের ঘেরাটোপে বাহির জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন সেই সময়ে বিদূষী রোকেয়া লিখে ফেললেন এক ইতিহাস, ভারতবর্ষের সাহিত্য ইতিহাসের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘সুলতানা’স ড্রিম’। নিজের ইংরেজি দক্ষতা স্বামীর কাছে তুলে ধরতেই তাঁর এই প্রয়াস কিন্তু অজান্তে করে ফেললেন দারুণ এক সৃষ্টি। এই সেই লেখা যা সায়েন্স ফিকশনের আদলে নারীমুক্তির কথা বলা হয়েছে, নারীর অকল্পনীয় শক্তির কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে প্রকৃতির শক্তি যথাযথ ব্যবহারের কথা।
‘সুলতানা’স ড্রিম’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামহীন এক চরিত্রের বর্ণনায় নারী চালিত এক ভূমি বা দেশের প্লটে তৈরি করা হয়েছে সুশাসন, পরিকল্পিতভাবে চালিত, শান্তির এক দেশের চিত্র যার নাম ‘লেডিল্যান্ড’। সে দেশ পরিচালিত হয় নারীর বুদ্ধিমত্তা আর সাহস দিয়ে, কোন পেশী-শক্তি দিয়ে নয়। এ-দেশে নারী-শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয় আইন করে, নিশ্চিত করা হয় নারীর সঠিক শিক্ষার। শুধুমাত্র নারী শিক্ষা দিয়েই লেখক নারীর আভ্যন্তরীণ শক্তিকে এমন এক জায়গায় দেখতে পান যা দিয়ে মোকাবেলা করা সক্ষম তাবত বাহ্যিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
‘সুলতানার স্বপ্নে’ বর্ণিত লেডিল্যান্ডে নারীরা নির্বিঘ্নে ঘরের বাহিরে চলাচল করে, যাবতীয় কাজ নিশ্চিন্ত মনে সম্পন্ন করে কারণ প্রতিবন্ধকতাকে করা হয়েছে ঘর-বন্দী অর্থাৎ পুরুষদের অবস্থান গৃহের ভেতরে। চিত্রটা পুরোই বিপরীত সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। যে সময়ে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখা হয় তখন নারীরা ঘরের বাহিরে বের হওয়ার কথা ভাবতে পারতো না। বের হলেও পর্দার আড়ালে নিজেকে ঢেকে, কোন পুরুষ সঙ্গীর সাথে বের হতে হতো। বাহিরের আলো দেখার স্বাধীনতা নারীর ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেন ‘লেডিল্যান্ড’ এর যেখানে পুরুষ থাকবে ঘরের ভেতরে আর বাইরের তাবত কাজ করবে নারী। শুধু মাত্র দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর কাজে পুরুষ অংশগ্রহণ করবে।
বিজ্ঞানের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে নারী জাতি যে একটা সুন্দর দেশ উপহার দিতে পারে তার সহজ এক পথ উন্মোচন করে দেখান বেগম রোকেয়া। যদিও ফ্যান্টাসি এবং একটা ফিকশন ‘সুলতানা’স ড্রিম’ জীবনকে সহজ করতে যে-উপায় বাতলে দিয়েছেন তা’ অধুনা এই জীবনে ভীষণরকম জরুরি।
সবশেষে, এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটা দিক হলো বেগম রোকেয়ার সেই নিরক্ষর সময়ে প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা। এই বিজ্ঞ নারী সেই সময়ে প্রকৃতি রক্ষার কথা বলেছেন, প্রকৃতির শক্তিকে যথাযথ ব্যবহারের কথা বলেছেন। শত বছর আগে দূরদর্শী এই বিদূষী নারী যে ভাবনা ভেবেছেন শত বছর পরে তা এখন নিরেট সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে, তার শক্তিকে ব্যবহার করার উপায় যদি তখনই ভাবা হতো পৃথিবীর আজ এই ভয়াবহ চিত্র দেখতে হতো না।
‘সুলতানা’স ড্রিম’ এর মধ্য দিয়ে আমরা বেগম রোকেয়ার অনন্য কিছু গুণের পরিচয় পাই, তিনি পরিষ্কার এক নারীবাদী, সমাজসংস্কারক, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক এবং একইসাথে পরিবেশ চিন্তক।