আমাদের নানা অভাবের মধ্যে একটা অভাব উৎসবের। বাঙালি মুসলমানের জীবনে ঈদ–কোরবানি–ঈদের বাইরে সর্বজনীন অনুষ্ঠানের ভীষণ অভাব। বছরে ওই দুইবার, ওই দুই উৎসবে, আমরা নিজের ঘরের বাইরে এসে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করি। অন্তত করবার একটা সুযোগ পাই। এই মিলনের তাৎপর্যের কথা আমরা অনেককাল অনেক বড় করে বলেছি, বলেছি এই দুই উৎসবে আমাদের ধর্মীয় জীবনের অন্তর্লগ্ন রূপটি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, ধনী–নির্ধন, ধনী–গরিব কোনো পার্থক্য থাকে না। অনেক কাল ধরে বলেছি, কিন্তু যতোই কাল যাচ্ছে ততোই এই কথার বিপরীতটাই বেশি করে সত্য হয়ে উঠছে। ঈদে এখন ঐক্য আসে না, অনৈক্যটাই উৎকট হয়ে ওঠে। ঈদে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ছোট ছেলেমেয়েরাই, হওয়া উচিতও, বয়স্করা ঈদের দায়িত্বে বিব্রতই হন। মধ্যবিত্তের পক্ষে ঈদ এক প্রকারের দুশ্চিন্তা, একেবারে বিত্তহীনদের কাছে হতে পারে কিছুটা উপরিপাওনার সুযোগ। আর ওই ধনী–নির্ধনের পার্থক্যটা এই উৎসবের ভেতর যেমন স্পষ্ট করে, দুঃসহ হয়ে, চোখে পড়ে তেমন বোধ হয় বছরের আর কোনো সময় পড়ে না। ভিক্ষুক ও ভিক্ষাদাতার চরম দূরত্বটা তো আছেই, তার বাইরেও সমাজের সকল স্তরেই কেনা–কাটায়, পোশাকে–আশাকে, বিশেষ করে খাবারের আয়োজন–উপভোগে একের সঙ্গে অপরের পার্থক্যটাই দপদপ করে চতুর্দিকে জ্বলতে থাকে। আর ওই যে মিলন সেও পরিচিত আপনজনের মধ্যেই। এক ঘর থেকে বার হয়ে আমরা অন্য ঘরে মিলিত হই। যখন বাইরে এসে কোলাকুলি করি তখন কোলাকুলির হট্টগোলের মধ্যে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়, যে ঘূর্ণিপাকগুলো পরস্পর–বিচ্ছিন্ন, যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ করে কোরবানির ঈদ যখন আসে তখন তো অনেকের মনে আতঙ্কও সৃষ্টি হয়। যেমন আমার হয় সেই প্রতিবেশীর ভীষণ–প্রসন্ন অত্যুৎফুল্ল চেহারা দেখতে পাবো আশঙ্কা করে, যখন দেখা যাবে উন্মুক্ত ভোজালি হাতে তিনি চলেছেন কোরবানির সওয়াব হাসিল করতে।
এটা মেনে নেওয়াই ভালো যে ঈদ আর তেমন ঐক্যের অনুষ্ঠান নয়। তবুও ঈদ তো মাত্র দু’বার আসে বছরে। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনো উৎসবের দিন নয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে উৎসবের উপলক্ষে পরিণত করলে বরং অপমান করা হয় শহীদদেরকে, অমার্যাদা ঘটে এর তাৎপর্যের। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি ঐক্য প্রতিষ্ঠার দিন, ঐক্যকে দৃঢ় করবার দিন। যখন দেখি যে, আত্মদানের স্মৃতি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, যখন দেখি অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসেছে, যখন শোনা যায় ঘুম ভেঙেছে চতুর্দিকে, ফুলের মালায় গানের কলরবে তখন একটা নতুন সংবিতকে দেখতে পাই, একটা নতুন সম্পর্ককে চিনতে পারি। ঐক্যসৃজনকারী তাৎপর্যে ঈদের অনুষ্ঠান থেকে এই দিন উদ্যাপন ভিন্ন, কেননা এতে আমরা শুধু যে আত্মীয়–পরিচিতের সঙ্গে মিলিত হই তা নয়, অনেক অপরিচিত, অচেনা মানুষের সঙ্গে একটা ঐক্যের সূত্রে গ্রথিত হয়ে উঠি আলিঙ্গন না করেও। এই দিনে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোনো চেতনা নেই, একটা অনুভবের মধ্য দিয়ে অন্যের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাই, নিজেকে অনেক দূর বিস্তৃত করে দিই। এই ঐক্য ধর্মনিরপেক্ষ, শুধু এই কারণে বা এই অর্থে নয় যে, পার হয়ে যাই আমরা সাম্প্রদায়িক ব্যবধানের প্রান্তসীমা, বরং এই অর্থে আরো বেশি যে, ধর্মের ধর্মীয় সীমা, অর্থাৎ এর জগৎবিমুখ আধ্যাত্মিকতা ও পারলৌকিকতা, পার হয়ে আমরা হয়ে উঠি জাগতিক ও ইহলৌকিক। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ধর্মনিরপেক্ষ দিন বাংলাদেশে কম আছে, কবর জিয়ারত সত্ত্বেও। অন্যদিনটি হলো পহেলা বৈশাখ।
দেখি যার সঙ্গে আজিমপুরে দেখা হয়েছিল, তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছি শহীদ মিনারের নিচে, অথবা পরবর্তী কোনো সভা–প্রাঙ্গণে। যে–সঙ্কলন এক জায়গায় কিনেছি সেই সঙ্কলন অন্য জায়গাতেও বিক্রি হচ্ছে। সেই একই বক্তা একই কথা বলছেন, যা গত বছরেও বলেছিলেন, যা আগামী বছরেও হয়তো বলবেন। সেই একই লেখা, একই ধরনের লেখা। একই প্রকাশ, একই অনুষ্ঠান। তখন মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে–একটা জাগরণ এসেছে হৃদয়ে, যে–জাগরণ গুঞ্জরণ করছে ভেতরে, আমার ভেতরে, অন্যের ভেতরে, সকলের ভেতরে, সেটা যেন আটকা পড়েছে একটা জালে–ঘেরা খাঁচায়, কিছুতেই পথ পাচ্ছে না বের হয়ে যাবার, অথচ বের হয়ে যেতে তার ভীষণ আগ্রহ, বহির্গমনের আয়োজনে একটা থর্ থর্ অস্থিরতা। এই কথাটা ভাবতেই খুব দুঃখ হয়, খেয়াল হয়, মহৎ অনুভবের এ কি অসামান্য অপচয়, প্রাণচাঞ্চল্যের এ কি নিদারুণ ব্যর্থতা। তখন এও বোঝা যায় যে এই অনুভবের, এই চাঞ্চল্যের সম্ভাবনা সর্বক্ষণই ছিল, আমরা টের পাই নি, আমরা তাকে কাজে লাগাই নি। কাজে না লাগানোর গ্লানিটা তখন খুব বড় হয়ে বাজে। সন্দেহ হয় অনুপ্রেরণা শেষ পর্যন্ত ফুঁসে–ওঠা আতসবাজির মতো অবসিত নিষ্প্রাণতায় পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়বে, একুশে ফেব্রুয়ারির তাজা ফুলগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে আবার আমরা ছোট ছোট ঘরে ফিরে আসবো : উন্মুক্ত প্রান্তরে যারা মিলেছিলাম তারা সামান্য কুটিরবাসী দিনানুদৈনিকতার ভেতর ঠিকানাবিহীন হয়ে হারিয়ে যাবো।
অনুভব ও অনুপ্রেরণা যে প্রকাশের পথ পাচ্ছে না তার একটা প্রমাণ ও লক্ষণ তো এই যে, ভেতরের চাঞ্চল্যকে আমরা বাইরের কোনো অনুষ্ঠান কি প্রতিষ্ঠান, সৃজন কি উদ্ভাবনের ভেতর প্রতিফলিত করতে পারি নি। উৎসাহ প্রত্যক্ষ অবয়ব গ্রহণ করে নি। সাহিত্যই বলি কি সামাজিক পরিবর্তনই বলি, কোনো বড় কাজের ভেতর আমাদের প্রাণের যে–অস্থিরতা তা সৃষ্টিশীল প্রতিরূপলাভ করতে পারেনি।
তার চেয়ে কম মর্মান্তিক নয় এই সত্য যে, দেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় খুব অল্পলোকের জীবনেই একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। আমরা জানি এই দিনে আমরা ঐক্যবদ্ধ হবো কিন্তু সেই ঐক্য–চেতনা ক’জনের? সমাজের কত বড় এলাকায় তার বিস্তার? একুশে ফেব্রুয়ারি তো শিক্ষিত মানুষের অনুষ্ঠান, আর দেশে শিক্ষিত মানুষ ক’জন? তাই দেখা যায় শহরেই থাকে এই দিনটি আবদ্ধ। গ্রামে যে যায় সেও গ্রামের বিদ্যালয়টি পর্যন্তই। অল্প ক’জনের জন্যই এই সর্বজনীন অনুষ্ঠানটি আসে। বাদ–বাকি যারা তারা হয় দর্শক, নয়তো এ বিষয়ে বেখবর। অর্থাৎ শুধু যে ধনী–নির্ধনের তফাৎটাই আবার নতুন করে প্রকট হয়ে ওঠে তা নয়, আরো একটা বৈষম্য চোখে পড়ে– শিক্ষার বৈষম্য, সংস্কৃতি–চর্চার বৈষম্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তুলনায় বিত্তবান যারা তাদের জন্যই, শিক্ষিত যারা, যারা চিৎকর্ষের কারিগর তাদের কাছেই এর মূল্য।
একুশের এই জাগরণ যে সর্বগ্রাসী হতে পারছে না তার কারণ কি? অন্তরায়টা কোথায়? একটা প্রধান অন্তরায় অবশ্যি ধনবৈষম্য, যে–কারণে ঈদের চাঁদ সকল গৃহে সমান আলো বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়। আরো একটা অন্তরায় হচ্ছে ভাষা। প্রথমত, বিদেশি ভাষার একটা অনেক বড় পাথর আছে দরজার উপর চাপা। এই ভাষাতেই আমাদের ভাবনা–চিন্তা বলা–কওয়া; এক সময় ছিল যখন এতেই চলতো আমাদের স্বপ্নদেখা। এই ভাষাটা দেশের না এ–ভাষা শিক্ষিতরাও বোঝেন না ঠিকমত, ব্যবহার করতে পারেন না যথার্থরূপে। এই অসম্ভব পরিস্থিতির পরিবর্তন অবশ্যিই দরকার। সে–কথা আমরা বলছিও। পরিবর্তন হচ্ছেও, ধীরে ধীরে।
পরিবর্তনটা শুধু একটা অবস্থার নয়, পরিবর্তন একটা মনোভঙ্গিরও। সেই জিনিসটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের মুসলমানদের জীবনে ভাষা ছিল একটা বৈষম্যের প্রতীক। যেহেতু স্থানীয় মুসলমানরা ক্ষমতার সিঁড়িগুলোতে বসবার সুযোগ পায়নি তাই স্থানীয় মানুষের ভাষা কখনো আভিজাত্যের গৌরবচিহ্ন অর্জন করেনি। বাংলা কখনো রাজভাষা ছিল না। সেই জন্যই যাঁরা অভিজাত, যাঁরা বীর বলে সম্মানিত তাঁরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করা দূরে থাক, বরং বাংলা যে জানেন না এই খবরটাকে উঁচু গলায় প্রচার করেছেন। যাঁরা গৌরবান্বিত তাঁরা বাংলা জানতেন না, তাই যাঁরা সেই গৌরবের আলো নিজেদের গায়ে মেখে নিতে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন তাঁরাও বলেছেন, দেখো, দেখো, বাংলা আমার ভাষা নয়। এককালে আভিজাত্যের ভাষা ছিল ফার্সী, পরে উর্দু, তারও পরে ইংরেজি। অর্থাৎ কিনা বীর যাঁরা তাঁরা সবসময়েই দেশ থেকে দূরে থেকেছেন, এবং যিনি যত দূরে থাকতে পেরেছেন তাঁর বীরত্ব ততো নিঃসংশয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ যদি বাংলাকে গ্রহণ করি তাহলে এই মনোবৃত্তিতেও পরিবর্তন আসবে।
এখনো আসে নি। এখনো সামাজিক পর্যায়ে বীরের সম্মান তাঁদের জন্যই তুলে রাখি যাঁদের মুখে বাংলা ভাষা অহরহ উচ্চারিত হয় না। ইতিমধ্যে গাড়ির নম্বরে, দোকানের সাইনবোর্ডে, চিঠির প্যাডে বাংলা অক্ষর ব্যবহার করা হোক এই কথাটা খুব করে বলছি। ব্যবহার হচ্ছেও, আরো হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই যে গাড়ি, বড় দোকান, চিঠির প্যাড এই সব একটা নির্দিষ্ট এলাকারই ব্যাপার, শহরের একটা অংশেই এসব বস্তুর বিশেষ সংস্থান, সেই অংশে যেখানে বিত্ত ও সংস্কৃতি প্রায় যমজ ভাইয়ের মতো সানন্দে বসবাস করছে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ এমনকি বাংলা ভাষার ব্যবহারও জানে না। কাজেই ভাষা–সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। বাংলা চালু হওয়া মাত্রই যে হঠাৎ করে দেশের অধিকাংশ মানুষের একটা খুব উপকার হবে এমন আশা করা যায় না। তবে হ্যাঁ, গৃহে প্রত্যাবর্তনের কাজটা শুরু হবে, আমরা দেশমুখো হবো; যে লোক নিজের বাসগৃহ নিয়ে ভয়ানক লজ্জিত ও আত্মসচেতন ছিল তার সেই ম্রিয়মান অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে। আর বিদ্যার্জনও কিছুটা সহজ হবে– মাতৃভাষা ব্যবহার করলে যা সকল সময়েই হয়ে থাকে। কিন্তু কতটা সহজ হবে সে বিষয়ে যেন কোনো ভ্রান্ত প্রত্যাশা না থাকে আমাদের। টাকার জোরটাই আমাদের সমাজে আসল জোর, সেই জোরেই শিক্ষা–প্রতিষ্ঠানের বন্ধ দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলতে হয়। এই জোরটা খুব অল্প মানুষের আছে। ভাষার জোর আসার আগে যে টাকার জোর দরকার সেই জোরটা এখনো আসেনি– না–আসার ব্যাপারকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের, অতি অবশ্যি। তবু ঘরের দিকে চোখ ফেরানোর ব্যাপারটা একটা অত্যন্ত শুভসূচনা; ঘরের হাল ওই তাকানো থেকেই ফিরতে পারে। বলা বাহুল্য, এখনো আমরা ঘরের দিকে ভালো করে, পুরোপুরি তাকাতে অভ্যস্ত হয় নি। হই নি যে তা বোঝা যায় আমাদের খবরের কাগজগুলোর প্রথম পৃষ্ঠার দিকে তাকালেই। যে–কাগজটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি বাংলা কাগজ নয়, আর ইংরেজি কি বাংলা সব খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক সংবাদের ছড়াছড়ি। এতো বেশি মেকি আন্তর্জাতিকতাপনা অন্যকোনো দেশে আছে কিনা খুব সন্দেহ। এককালে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসের পরীক্ষায় প্রার্থীদের জ্ঞান দেখা যেতো বিদেশের ব্যাপারে ভীষণ চৌকস, স্বদেশের ব্যাপারে অনেকটা সংকুচিত। এখনো তা–ই সর্বত্র যোগ্যতা বিচারের মানদণ্ড, ওই নানান খবর একেবারে নখদর্পণে রাখতে পারাটা।
ঘরে ফেরাটা খুব দরকারি কাজ, কিন্তু এ কাজ করতে যেয়ে দেখা দরকার হবে যেন আমরা ঘরে ফেরাটাকেই যথেষ্ট মনে না করি। যেন এমন অবস্থা না হয় যে অভিমান করে দরজা দিলাম বন্ধ করে, অর্জন করলাম না নতুন সম্পদ, যা ছিল পিতা–পিতামহের আমলের তার উপরেই ভরসা করে করে রইলাম বেকার হয়ে। ঘরে ফিরবো ঘরে থাকার জন্য, বেকার হবার জন্য নয়। ঘরে ফিরে ঘরের অবস্থান পাল্টে দেবো। জমানো বিত্ত কখনো যথেষ্ট নয়, বিত্ত সৃষ্টি করা প্রয়োজন নতুন করে, প্রতিনিয়ত, অনলস সাধনায়।
বাংলা ভাষাকে অহরহ ব্যবহার না করায় অনেক গ্লানি ও বিড়ম্বনা আছে। শিক্ষিত মানুষ আর যাই হোক বোবা মানুষ নয়; নিজেকে ব্যক্ত করতে পারছে কিনা, আত্মপ্রকাশ সম্ভবপর হচ্ছে কিনা শিক্ষা–বিচারে এই একটা নিশ্চিত নিরিখ। কিন্তু দেশের অনেক শিক্ষিত মানুষই দেখা যাবে নিজেকে প্রকাশ করতে জানে না। যখন বাংলার আত্মপ্রকাশ করতে যেয়ে কষ্টে পড়েন তখন সলজ্জ হাসিতে সেই ব্যর্থতাকে আচ্ছাদিত করে বলেন, এর কারণ তাঁর অনভ্যাস। যেন ইংরেজিতে ভালো পারেন; অথচ ইংরেজি ব্যবহার আরো করুণ। কিন্তু এই অপরাগতা নিয়ে কোনো লজ্জা নেই; উল্টো এ ব্যর্থতার সব দায়দায়িত্ব নিয়ে গিয়ে চাপানো হয় নিরাপরাধ ওই বাংলা ভাষার কাঁধেই। যেহেতু মাথা থাকলেই মাথা ব্যথা থাকে তাই মাথা ছেঁটে–ফেলাই ভালো, প্রায় এই রকমের যুক্তি খাড়া করেই বাংলা ভাষাকে সহজ করবার অস্থির উদ্যম চলেছে অনেক মহলে। আর যেহেতু আমরা ভাষার বিষয়ে প্রায়ই অচেতন, তাই চেষ্টাটা সে শুধু চলতে পেরেছে তাই নয়, বেশ বাহবাও পেয়ে গেছে বিশেষ বিশেষ মহল থেকে। অবশ্যি এর সঙ্গে একটা ষড়যন্ত্রও জড়িত আছে, সেই ষড়যন্ত্র যা এক সময়ে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল, যা আরবি হরফে বাংলা চালু করার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিল। ঘরে ফেরাকে বিলম্বিত করার কাজে এই ষড়যন্ত্রের অবদান আছে। গোপন বাসনা ছিল যেন আমরা চিনতে না পারি নিজেদেরকে, যেন বিচ্যুত ও বঞ্চিত হই ভাষার ঐতিহ্য থেকে।
একুশে ফেব্রুয়ারির সংবিত যে সর্বত্র বিস্তৃত ও সর্বত্রগামী হতে পারছে না তার আরও কারণ আছে। যে সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই সংবিত ছড়িয়ে পড়তে পারতো তাদের দরজাগুলো বন্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছি আগেই, সেখানে সকলে ঢুকতে পারে না, কেননা তার দরজা কেবল সোনার কাঠিতে খোলে। ব্যাপারটা প্রায় রূপকথারই মতো। যারা ঢুকেছে ভেতরে তারাও নিজেদের বক্তব্য স্বাধীনভাবে প্রচার করবার সুযোগ পায় না। যেন আটকা পড়েছে। খবরের কাগজগুলো যে নিতান্ত স্থূল অর্থে, শারীরিক অর্থে, সকলের কাছে পৌঁছবে সে–সম্ভাবনা কম। কিনবার ক্ষমতা নেই লোকের। আর চলাচল ও যানবাহনের অবস্থা অত্যন্ত হাস্যকর। তদুপরি কাগজের উপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আছে। কাগজগুলো বিশেষ বিশেষ লোকের করতলগত। বেতার ও টেলিভিশনের কথা না বলাই ভালো। অর্থাৎ কিনা বক্তব্য উপস্থাপনের স্বাধীনতা কোথাও নেই। না–থাকলে ঐক্য গড়ে উঠবে কি করে? মতামতই তো সূত্র হয়ে বিচ্ছিন্ন মানুষকে একত্র করে; বোবা যারা তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবার উপায় কি? এমনকি ইশারা করার জন্যও খানিকটা স্বাধীনতা আবশ্যক।
বক্তব্যের চেয়েও বড় শক্তি হলো সাহিত্য। সাহিত্য অনেক বেশি স্থায়ী ঐক্য আনতে পারে, কেননা সাহিত্যের ঐক্যটা হৃদয়ের ঐক্য, অনুভবের ঐক্য। বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের তফাৎ আছে, বুদ্ধি নিজেকে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, নিজের উৎকর্ষ সপ্রমাণ করতে চায়, করতে চেয়ে অন্যের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে হাসি–ঠাট্টা, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করে। সাহিত্য কতটা তৈরি হয়েছে, কি ধরনের সাহিত্য তৈরি হয়েছে এ একটা প্রধান জিজ্ঞাসা। সাহিত্য–সৃষ্টির জন্য যে আয়োজনের প্রয়োজন তাও নেই। যেমন ধরা যাক, সাহিত্য পত্রিকার কথা। লোক–সংখ্যা, পাঠক–সংখ্যা সব কিছুই বেড়েছে, কিন্তু একটিও নিয়মিত প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা নেই আজ বাংলাদেশে।
ভাষার বিকাশ শুধু ভাষার ব্যবহারের উপরই নির্ভর করে না, ভাষার মাধ্যমে যে বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে তার উপরই বরং নির্ভর করে অধিক। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক জনপদেই নিজস্ব সাহিত্যিক ভাষা এখনো গড়ে ওঠেনি, অনেক জায়গাতেই বিদেশি ভাষা ব্যবহৃত হয়, অনেক লেখকই ধর্মে খ্রিস্টান; কিন্তু তবু তাঁদের লেখার ভেতর এমন একটা প্রত্যয় ও দৃঢ়তা ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে যাতে সন্দেহ থাকে না আফ্রিকার তথাকথিত শতাব্দী–লাঞ্ছিত অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে আজ নতুন সূর্যের অভ্যুদয় ঘটেছে। তেমন কোনো জাগরণের খবর আমাদের সাহিত্যে শুনতে পাই কিনা সে–কথা আমাদের বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন।
অশ্রুসিক্ত ভাবালুতা আলোর মিত্র নয়, আলোর শত্রু। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংখ্যাহীন স্ফুলিঙ্গ জ্বলে–জ্বলে ওঠে, কিন্তু তারা মিলিত হয়ে যদি আলোর কেনো ঝর্ণাধারা তৈরি না করে, তবে সে–অপচয় অতিবড় ক্ষোভের, দুঃখের ও লজ্জার কারণ বৈকি। অনেক স্ফুলিঙ্গের ঐক্য মহৎ এক আলো জ্বলে ওঠুক এটাই কাম্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়