অনিদ্রার অনত কারুকাজঅ

আরফান হাবিব | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মানস-লোকের অনুভূতি ও কল্পনার অনিবার্য প্রতিফলন কবিতা। কবির একান্ত অনুভব- কবিতার শরীরে নিমজ্জিত হয়। যার পটভূমি জুড়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দৃশ্যগত রূপাভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে পরিচিত পৃথিবীর। শব্দকে রং এর মতো ব্যবহার করে বর্ণবিভায় সমসাময়িক সমুৎপাদিত শিল্পসত্তার জাগরণ বাংলা কাব্যে খুব বেশি উদ্বেলিত- এমনটা বলা যাবে না। এ প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রমী এবং স্বচ্ছল একজন কবি ভাবোন্মেষকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে আপন মনে নিমজ্জিত থেকে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন অনিদ্রার অনত কারুকাজ- তিনি কবি ময়ুখ চৌধুরী।
সমসাময়িক কবিতায় যেখানে আমরা অলঙ্কারের ঝঙ্কার শুনেছি কিংবা পদের পরস্পর সংলগ্নতার ধ্বনি কলরব করে উঠতে- সেখানে ময়ুখ চৌধুরীর শব্দ ব্যবহার লক্ষ করার মতো। যেমন-
জ্যোৎস্নায় অভ্যস্ত আমি, তবুও ঢেলে দিলে অন্ধকার
হাতে মাত্র তিনদিন, তারপর এপার ওপার। (দেখা নেই)
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় শব্দ তার নিজের অর্থ বহন করে না, দৃষ্টিগোচর হয়ে নির্দেশক কোলাহল তৈরি করে। নতুন বোধের দ্বার উদ্‌ঘাটিত হয় সহজেই। যখন কবি বলেন-
তোমার নরম অহংকার
পারবে সেলাই করে দিতে-
তোমাকে প্রেরণা বলে ডাক দিলে এই পৃথিবীতে? (প্রেরণা)
‘অনিদ্রার কারুকাজ’ বই এর কবিতাগুলো কবির কাব্যচর্চার সারাংশ বলাই যায়। কেননা, কবিতাগুলো ১৯৭০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময় পরিসরে রচিত। ফলে কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য সহজেই এখানে দৃশ্যমান। কিন্তু বাংলা কবিতার শরীরে উপমা, অলঙ্কারের অতিরিক্ত পরিচর্যার ঐতিহ্যগত চর্চা এখানে প্রায় অনুপস্থিত। যেমন-
আমাদের ছোট নদী আজীবন পার হয়ে যায়।
পৃথিবীর বিরাট মেলায়
কেউ আসে কেউ যায়, ফিরে আর আসে না কখনো। (তুলনার হরিণ)
কবি কি বলছেন তা পাঠক কবিতায় প্রকাশিত ভাবগত ঐশ্বর্যের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে- উচ্চারিত কথামালা বুঝতে পারেন। ক্রমশ পাঠক কবির কাছে আসেন এবং কবির সত্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আপন মাধুর্যে স্বয়ম্প্রভ হন। ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় পরিভ্রমণ করলে পাঠক সহজেই এমন মূল্যবান অভিজ্ঞতার কারুকাজ দেখতে পাবেন। কেননা তিনি যখন বলেন-
তোমার আমার মধ্যে সে-রকম কোনো মিল নেই
তুমি দেখো ব্যক্তিগত চাঁদ স্নানঘরে, জলের ধারার শিহরণ,
আমি দেখি মেঘে-ঢাকা চাঁদ-রুপালি আকাশে। (তুমি শিল্প, তুমি অনিদ্রার কারুকাজ)
কবিতার ভাব এবং ভাষা একত্রে উদ্ভাসিত হয়, বিচ্ছিন্নভাবে তার সৌন্দর্য নিরীক্ষণ সম্ভব নয়। ময়ুখ চৌধুরী তার প্রায় কবিতায় এ বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যেন কবিতাকে তিনি ভাবের সৌন্দর্যে প্রকাশ করছেন, তেমনি একটি উদাহরণ-
এসব দৃশ্যের কথা ভেবে
অগ্নিকাণ্ড বুকে নিয়ে সারা রাত জেগে থাকে
ধ্রুপদী হেলেন ।
চক্ষুষ্মান অন্ধদের এই দৃশ্য দেখাবেন বলে
পৃথিবীতে হোমার এলেন।(হোমারের চোখ)
কবিতার পাঠক কম-এ বিষয়টি যখন ভাবনার চারপাশে উদ্ভাসিত হয়, তখন চোখের সামনের কবিতার জগতকে নিছক আবরণের মতো মনে হয়। বুঝতে হবে পাঠক চিত্তগ্রাহী কবিতালোক থেকে বিছিন্ন। কবিদের দায়িত্ব প্রায় সব কালে উচ্চারিত এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। নয়তো পাঠক সত্যিকার ভাবেই কমে যাবে। অদৃশ্য কালি দিয়ে কবিতা না লিখে দৃশ্যগোচর তাৎপর্য উন্মোচিত কাব্যচর্চাই পারে ভবিষ্যৎ এর পাঠকদের স্নিদ্ধ ও সিক্ত করতে। বর্তমান-ভাবি পাঠক এবং কবিদের জন্য এমন প্রেক্ষাপটে ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ বই এর প্রতিটি কবিতায় স্পর্শ-সঞ্চারী বার্তা প্রগাঢ়তায় আমরা লক্ষ করি।
আমাদের চারপাশের দৈনন্দিন ভাষাকে আগ্রহীজনের কাছে জীবনের ধারাবিবরণী করে বিস্তৃত অংশে চিত্রিত করার শিল্পকর্মটিকে আমরা যদি কবিতা বলে মনে করি- তাহলে ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা পাঠের মধ্য দিকে গেলে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি লাগবে, যদি বা তাঁর সমগ্র কাব্যজগতের পরিচিতি সর্ম্পকে ধারণা না থাকে, তাহলে পাঠককে সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, দৈনন্দিন জীবনযাপন, অর্থনৈতিক অবস্থা, মনন ও বৌদ্ধিক বিকাশের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্লান্তিহীন একটি দীর্ঘ পরিভ্রমণের মধ্যে থাকতে হবে। পঞ্চাশ বছরের বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা- শ্যামলীর ছায়া, জাদুবাস্তবতা, মঙ্গলকাব্য কবিতাগুলো পড়লে তা স্পষ্ট হতে পারে।
সত্তর দশকের অন্যতম কবি ময়ুখ চৌধুরী তাঁর অর্ন্তমুখীতার কারণে কালসীমানার রেখা অস্পষ্ট রেখেছেন। সময়ের উত্তাল প্রবাহ থেকে বেরিয়ে কাব্য সাধনায় নিমগ্ন হয়েও কবি তার মৌলিক কবিতা যাপনের কারণে হয়েছেন স্বয়ং ইচ্ছা-পক্ষ কবি। গোষ্ঠীবদ্ধ কাব্যচর্চার বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখে দায়িত্ববান শিল্পিত প্রকাশ রীতিকে সামনে রেখে তিনি বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধতর করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি দক্ষতা ও অনিবার্যতার সাথে করে যাচ্ছেন- যার স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর সর্বশেষ এ গ্রন্থে।
প্রেম নিঃসন্দেহে ময়ুখ চৌধুরীর কবি ব্যক্তিত্বের পরম অবলম্বন কিন্তু একমাত্র নয়। প্রেমের কবিতার অপূর্ব রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর অনেকগুলো কবিতায়, যার শ্রেষ্ঠত্ব তুলনাবিহীন। যেমন-
তোমাকে সুন্দর হতে মানা করিনি তো,
তাই বলে এ রকমভাবে! (রেস্তোরাঁয়)
প্রকৃতপক্ষে কবিতার প্রথাসিদ্ধ সমস্ত বিষয়ই ময়ুখ চৌধুরী কবিতার অন্তর্গত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের দ্বারস্থ না হয়ে নিজের ঐতিহ্যগত সময়কে কবিতায় ফ্রেমবন্দি করার চমৎকার সংশ্লেষ ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ বইটি। অভিধানের সীমা বারবার ভাঙ্গার সর্বসঞ্চারী কৌশল কবির কবিতাকে করেছে উপলদ্ধি সংলগ্ন। উদাহরণ নিচের কবিতাংশে –
‘মজার ব্যাপার হলো, গোলাপ যে সুন্দর ,
গোলাপ কি জানে?’
‘জানে। গোলাপ জানে বলেই জন্মের
আগেই নিয়োজিত করে রাখে কাটার প্রহরী।’ (গোলাপ-প্রদর্শনী)
ছোট গল্পের মতো কবিতাকে উপস্থপন করার প্রকাশরীতি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার মৌলিক বৈচিত্র্য। জীবনের কঠিন গ্লানি মিশে যায় তাঁর কাব্যের অমৃতধারায়। ফলে তাঁর কাব্যশস্য যে সবসময় অধিকতর বিভূতিময়, তা বলাই বাহুল্য।

 অনিদ্রার কারুকাজ , কবি-ময়ুখ চৌধুরী, প্রকাশক-চন্দ্রবিন্দু (২০২২), প্রচ্ছদ- মোস্তাফিজ কারিগর, মূল্য-১৮০ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদরদীর কবর
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে এক ব্যক্তির আত্মহত্যা