অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী

মুসলেহ্‌উদ্দিন মুহম্মদ বদরুল | শনিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী, এক কীর্তিমান মেধাবী যুবক। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরনীতে। ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর মাত্র ২৬ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।
জসিমের জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর উত্তর আবাসিক কলোনীর বাসায়। শৈশব আর কৈশোর কেটেছে সেখানেই। প্রথম স্কুল ছিল বন্দর প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিকের পর বন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর কারণে গ্রামের বাড়িতে এসে রাউজান আর্য্যমৈত্রেয় ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। বাবা আব্দুল মোনাফ চৌধুরী ছিলেন বন্দর কর্মকর্তা। মা হোসনে আরা বেগম। ৩ ভাই আর ৪ বোনের মধ্যে জসিম ছিলেন পঞ্চম। ১৯৮৩ সালে রাউজান আর্যমৈত্রেয় ইনস্টিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। এরপর রাউজান কলেজ থেকে ইন্টার মিডিয়েট বা এইচএসসি শেষ করে ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে সম্মান সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন।
চট্টগ্রাম বন্দর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘টিপু সুলতান’ নাটকে অভিনয় ও হাসন রাজার ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে’ গানটি গেয়ে ব্যাপক প্রশংসা পান। সে থেকে শেষ সময় পর্যন্ত জসিম পড়ালেখাসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিভার দ্যুতি দেখিয়েছেন।
অনেকগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন জসিম। জাতীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আমরা পলাশ’ এর চট্টগ্রাম জেলার আহবায়ক, ‘বাংলার মুখ’ রাউজান কলেজ শাখার উপদেষ্টা, এবং এক সময়কার সক্রিয় ও বৃহৎ সামাজিক সংগঠন ‘জারুল তলা সমাজ কল্যাণ যুব পরিষদ’ এর উপদেষ্টাও ছিলেন আমৃত্যু। ‘চিটাগাং লায়ন্স ফাউন্ডেশন’ এরও সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতেও জসিমের মেধার মূল্যায়ন হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের জাতীয় ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম উত্তর জেলার (সভাপতি কাজী জসিম, রাঙ্গুনিয়া) কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আদর্শ ও চেতনায় ভিন্নতা থাকলেও বিরোধী মতের রাজনীতিবীদদের কাছেও জসিমের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। যা আজকের দিনে অকল্পনীয় ও অভাবনীয়। ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান চেতনা সমিতি’ আয়োজিত বিজ্ঞান লেখালেখি ও রিপোর্টিং শীর্ষক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে শাণিত করে নিয়েছিল জসিম। শিল্পকলা একাডেমি থেকে গান, আবৃত্তি ও অভিনয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাঁধে একটি সুন্দর চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজ গ্রাম থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে ছাত্রলীগের মত বৃহৎ একটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়ার মত সাহস ও যোগ্যতা একজন জসিমই ধারণ করতে পেরেছিলেন।
জসিম স্বপ্ন দেখতেন একটি সুন্দর সমাজের। সংগ্রাম ছিল একটি মহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠার। নিজ ঘরে গড়ে তুলেছিলেন বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ। হেন বিষয় নেই, যে বিষয়ের বই জসিমের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিলনা। অবসর সময়ে নিমগ্ন হয়ে থাকতেন বইয়ের জগতে। ছড়া লিখেছেন, কবিতা আর প্রবন্ধ লেখার হাত ছিল পাকা। দৈনিক আজাদী আর পূর্বকোণে ছাপা হতো সে সব লেখা। সাহিত্য প্রীতি ছিল জসিমের আরেকটি নেশা। রাউজান কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চায় জসিম ছিল অগ্রদূত। নগর বিদ্যার ব্যাকরণ মতে রাউজান কিন্তু শহরতলী বা মফস্বলও নয়। এমন একটি স্থান থেকে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনার দুঃসাহস জসিমই করেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রত্যাশা’। এর দুটো সংখ্যা ছাপা হয়েছিল। হয়তো অসুস্থতার কারণে এগুতে পারেন নি। এসব কাজের জন্য জসিম প্রশংসা পেয়েছিলেন কবি শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার কাছ থেকে। কবি শামসুর রহমান এক আশির্বাদ বাণীতে লিখেছিলেন- ‘জসিম হও অসীম।’ যদিও স্বশরীরে জসিম আমাদের মাঝে আর নেই কিন্তু সত্যিকার অর্থে অসীম হয়ে রয়েছে, মানুষের মন, মনন আর স্মরণে।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জসিম কর্ম জীবনে অধ্যাপনাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন। রাজানগর রানীরহাট ডিগ্রি কলেজে শিক্ষক হিসেবে এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, জসিমের পরিচিতি কলেজের বাইরে এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছিল। রাণীরহাট কলেজে প্রথমবারের মত ‘ইছামতি’ নামে শিল্পোত্তীর্ণ কলেজ বার্ষিকী প্রকাশ জসিমের আরেকটি কীর্তি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধার কারণে সেখানে অধ্যয়নরত রাউজানের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন ‘রাউজান ছাত্র ফোরাম’ এর নেতৃত্বে চলে আসেন। পরবর্তীতে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জসিমের উদ্যোগেই রাউজান ছাত্র ফোরামের ১০ বছর পূর্তি উদযাপন, ‘সুচেতনা’ শিরোনামের ম্যাগাজিন প্রকাশ, দেয়ালিকা প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং চালু করা, রাউজানের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গামী বাসের ব্যবস্থা প্রভৃতি চালু হয়। তখনকার সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকার রাউজান প্রতিনিধি ছিলেন জসিম। রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত ‘গিরিদর্পণ’ পত্রিকার সাথেও যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত লিখতেন ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ পত্রিকায়। রাউজান এলাকায় মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত এই জসিমের হাত ধরে উঠে এসে অনেকেই আজ সাংবাদিকতা পেশায় প্রতিষ্ঠিত।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মদীনার আলো

পূর্ববর্তী নিবন্ধএবার লড়াই করতে হবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিপক্ষে
পরবর্তী নিবন্ধহজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.)