অটিজম : প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা

| শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ ২ এপ্রিল শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি। প্রতি বছর জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও সমাজে তাদের কার্যকর একীভূতকরণের উদ্দেশ্যে।
অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত মানসিক ও শারীরিক একটি রোগ। যা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এই রোগ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অসচেতন। তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। অটিজমকে অনেকে মানসিক রোগ মনে করলেও এটি প্রধানত স্নায়ুবিক বিকাশ-জনিত সমস্যা। যে সমস্যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি আর দশজন মানুষের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজম স্নায়ুবিকাশ জনিত রোগ হলেও এই রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু বিষয়কে অটিজমের কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে, বংশে কারও অটিজমের সমস্যা থাকা, গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা করা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিমাত্রায় ওষুধ সেবন, মায়ের ধুমপান ও মদ্যপানসহ গর্ভকালীন সংক্রমণ যেমন : মাম্পস, রুবেলা, মিসেলস ইত্যাদি হওয়া।
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মায়ের সাথে পরিবারের সম্পর্কের ঘাটতি থাকা, বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়া, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, মৃগীরোগ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, মনোযোগ-ঘাটতি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার সিজোফ্রেনিয়া, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার।
সেইসাথে কম ওজনে শিশুর জন্ম হওয়া, গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত সিসাযুক্ত বাতাসে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া, প্রসবকালীন কোনো জটিলতা, মা ও শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যা ইত্যাদি কারণেও অটিজম হতে পারে।
অটিজম শিশুর জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। লেখক সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, অটিজম সম্পর্কে আমাদের দেশে আলোচনা হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ সামাজিক সচেতনতা এখনো সৃষ্টি হয়নি। বিশেষ করে আক্রান্ত শিশুর পরিবার পরিজনেরাই কখনো এই জাতীয় শিশুকে মেনে নেয় না। ফলে শিশুটি জন্মের পর থেকেই অবহেলিত হয়। যদিও বিগত কয়েক বছরে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বহুগুণ বেড়েছে।
সচেতনতার কারণে অনেক বেশি অটিজম শিশুরা শনাক্ত হচ্ছে এবং সঠিক পরিচর্যা ও সেবা পাচ্ছে। কিন্তু তারপরও অটিজম নিয়ে সমাজে ব্যাপক ভুল ভ্রান্তি রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অটিজম সম্পন্ন শিশুর মা-বাবারা সহজে মেনে নিতে চায় তার সন্তানের অটিজম আছে। এরা এই শিশুকে পাপের ফসল বলে মনে করে। ফলে দীর্ঘ সময় একটা বিভ্রান্তিতে থাকতে থাকতে উপযুক্ত পরিচর্যা আর প্রশিক্ষণের সময় নষ্ট হয়ে যায়।
এতোকিছুর পরও পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে যতটুকু সচেতনতার প্রয়োজন তা পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। তাই সরাসরি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরও বেশি বেশি সচেতনতামূলক কর্মপরিকল্পনা নেয়া উচিত। কেননা এই রোগে আক্রান্তদের এখনো লোকে পাগল মনে করে বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের সাথে অটিজমকে এক করে ফেলে।
তাই অটিজমকে পাঠ্যপুস্তকের আওতাভুক্ত করে এর ব্যাপক প্রচারণা করা উচিত। সেইসাথে গ্রাম পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে এই শিশুদের ভার সরকারের নেওয়া উচিত। কেননা আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা না থাকায় তারা এই জাতীয় রোগের চিকিৎসা করাতে আগ্রহী হয় না। ফলে এই রোগে আক্রান্তরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবহেলিতই থেকে যায়। তাই অটিজম সম্পর্কে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে ব্যাপক সচেতনতা ও সহায়তা বৃদ্ধি হওয়া খুবই প্রয়োজন।
তবে বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে ‘স্নায়ুবিকাশগত প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ পাস হয়েছে এবং তার ফলাফল হিসেবে নিউরোডেভলপমেন্টাল সুরক্ষা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে, অটিজম রিসোর্চ সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর কার্যক্রম সমপ্রসারিত হয়েছে। বেশিরভাগ বড় সরবারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে মিডিয়াতেও অটিজম বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে অটিজম শব্দটি আগের থেকে অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে। তবে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা তৈরি হয়নি। অটিজম সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়নি এবং সমাজে তাদের স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করে শিক্ষা, কর্মস্থানসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করণের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত অটিজম সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলা যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে