হেমন্ত কোথায় থাকে?

খালেদ হামিদী | বৃহস্পতিবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে

সাড়া থাকে, সচ্ছলতা থাকে।

মানুষের মতো নয়, ভেঙে ভেঙে জোড়ার ক্ষমতা

গাছেদের কাছে নেই

হেমন্ত বার্ধক্য নিতে আসে

খসায় শুকনো ডাল, মড়া পাতা, মর্কুটে বাকল

এইসব।

হেমন্ত দরোজা ভেঙে নিয়ে আসে সবুজ নিশ্বাস

মানুষের মতো নয় রক্তে পিত্তে সৌভাগ্য সরল

শিশুটির মতো রাঙা ক্রন্দন ছিটিয়ে চারিপাশে

হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে।।

[হেমন্ত যেখানে থাকে / শক্তি চট্টোপাধ্যায়]

হেমন্ত কোথায় থাকে? সম্রাট আকবর যেমাসকে, ফসল উৎকলন ও খাজনা সংগ্রহেরপরিশোধের সময়কাল হিসেবে, বৎসরের সূচনামাস গণ্য করেন, তা হেমন্ত ঋতুরই দ্বিতীয়ার্ধ, অগ্রহায়ণ। জীবনানন্দ দাশ ও পরে বিনয় মজুমদার একে অঘ্রাণ বলে ডাকেন। অগ্র ও হায়ণ, অর্থাৎ ধান ও তা কাটার মৌসুমের সমন্বয়ে কিংবা এই বিশেষ্য ও কালের সংযোগে অগ্রহায়ণ শব্দটি দাঁড়ায়। বাঙালির অস্তিত্বের সক্রিয়তার শর্ত বা মূল আহার আর তা ক্ষেত থেকে বাড়ির আঙিনায় কিংবা গোলায় এবং শেষে উদরে আনয়নের সমগ্র জীবনবাদী আয়োজনের মধ্যেই হেমন্ত অভিব্যঞ্জিত। এর সাংস্কৃতিক চমৎকার প্রপঞ্চ নবান্ন উৎসবে জাজ্বল্যমান। আমন ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না এবং প্রতিবেশিসহযোগে সম্মিলিতভাবে এর উপভোগ উপলক্ষে আয়োজিত এই শস্যোৎসবে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত কৃষিজীবী মানুষের পরিচ্ছন্ন অতুল আনন্দ তরঙ্গিত হয়। এবং, এর প্রকাশ ঘটে গান, নৃত্য ও নানান গ্রামীণ ক্রীড়ায় তথা সৃষ্টিশীল অভিব্যক্তির মধ্যে। কিন্তু নগরবাসী আমরা, এই উৎপাদন ও সৃজনযজ্ঞের অসামান্য স্পন্দনের কতোটুকু অংশীদার?

তাহলে নাগরিক জীবনে হেমন্তের স্বরূপ কেমন? এরই মধ্যে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ষড়ঋতুর চতুর্থ ও ষষ্ঠটি বিলুপ্ত প্রায়। এই অনুধাবন সম্পূর্ণ সঠিক না হলেও অনস্বীকার্য। তাহলে এখনো কেন নাগরিক মধ্যবিত্ত সাহিত্যপাঠকের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মধ্য দিয়ে, হেমন্ত স্মরণ? হয়তো এই ঋতুকালে সে জীবনানন্দকে অনুভবে ফিরে পায় আগে। মনে পড়ে বিনয়ের অঘ্রাণের অনুভূতিমালাও। এখনো বিদ্যমান সংবেদনশীল পাঠক দাশবাবুকেই বুকে অধিক জড়িয়ে নেয়। কিন্তু কেন? খুব সম্ভব, জীবনানন্দ হেমন্তে কেবল নবান্নের উৎসব দেখেননি, এ সময় মৃত্যুকেও অনুভব করেন আশ্চর্য গভীরতায়: ‘শীতের ঘুমের থেকে এখন বিদায় নিয়ে বাহিরের অন্ধকার রাতে/হেমন্তলক্ষ্মীর সব শেষ অনিকেত আবছায়া তারাদের/সমাবেশ থেকে চোখ নামায়ে একটি পাখির ঘুম কাছে/পাখিনীর বুকে ডুবে আছে,-/চেয়ে দেখি ;- তাদের উপরে এই অবিরল কালো পৃথিবীর/আলো আর ছায়া খেলেমৃত্যু আর প্রেম আর নীড়।’ (হেমন্তরাতে; বেলা অবেলা কালবেলা) তাঁর অন্য অনেক কবিতার মতো এক নিবিড় ঐহিক অধ্যাত্ম (শামসুর রাহমানকথিত) মেলে এই কাব্যেও। কবিতাটির উপর্যুক্ত প্রথম স্তবকেই নরনারীর প্রেম আর আবাসনের সঙ্গে একাকার হয়েথাকা মৃত্যুর আশ্চর্য চিত্রকল্প তিনি উপস্থাপন করেন। তা এমন যে, ‘ধূসরিম মহিলার নিকটে সন্নতমানবের বাষ্পাকুল প্রতীকের মতো’ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, কবি উৎকীর্ণ করেন এক গূঢ়তর জীবনজিজ্ঞাসা : ‘আরো ঢের পটভূমিকার দিকেদিগন্তরে ক্রমে/মানবকে ডেকে নিয়ে চ’লে গেল প্রেমিকের মতো সসম্ভ্রমে।/তবুও সে প্রেম নয়, সুধা নয়,-মানুষের ক্লান্ত অর্থহীন/ইতিহাসআকুৃতির প্রবীণতা ক্রমায়ত ক’রে সে বিলীন?’ (দ্বিতীয় স্তবক; প্রাগুক্ত) হেমন্তের রাতে কবির মৃত্যুবোধ এতো প্রগাঢ় হয় যে তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জীবনের নিখিল রেখামালাকে স্পর্শ করে।

কিন্তু জীবনানন্দের উত্তরকালীন কবি শক্তির কবিতায় হেমন্তের স্বরূপটি কেমন? তাঁর বহুলপরিচিত ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কবিতায় পুঁজিবাদসৃষ্ট মানুষেমানুষে পারস্পরিক দূরত্ব চিহ্নিত হয়। এই কবিতার সমাপ্তি পাঠককে চমকে দেয়। কেননা কবি এতে সকলকে মনে করিয়ে দেন যে, গাছসকল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষের ধরনে দূরত্ব রচে না। উপর্যুক্ত ‘হেমন্ত যেখানে থাকে’ কবিতায় কবি বলেন অন্য কথা। ‘হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে’এই তথ্য কি প্রকৃতই অশ্রুতপূর্ব? শ ভাগ নতুন উচ্চারণ তা হয়তো নয়। কিভাবে তা কিছুটা পরিচিত, বুঝতে চাওয়ার আগে, হ্রস্বাকৃতির আলোচ্য কবিতাটির চকিত পাঠ নেয়া যায়। কবি জানান, হেমন্তের অধিকরণে ‘সাড়া’ ও ‘সচ্ছলতা’ থাকে। তাতে প্রাগুক্ত নবান্ন উৎসবের সর্বপ্রকার প্রাণপ্রাচুর্যের চিত্রকল্প সামনে চলে আসে। কিন্তু তা আর সম্প্রসারিত হয় না। ফিরে আসে মানবিক বিচ্ছিন্নতায় বিচলিত কবির প্রাগুল্লিখিত মানসপট, কিছুটা ভিন্নভাবে। তিনি বাণীপ্রতিম উচ্চারণে এই বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মানুষের মতো কিছু ভেঙে ভেঙে জুড়নের ক্ষমতা বৃক্ষের নেই। লক্ষযোগ্য, উল্লিখিত অপর কবিতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন বৃক্ষকুলের ঐক্যে আনন্দিত তেমনি এই ‘পদ্যে (তিনি নিজের কবিতাকে যা ব’লে অভিহিত করেন)’ ‘গাছেদের’ অখণ্ডতায় মুগ্ধ। তারপরই, জীবনানন্দের ওই মৃত্যুর অনুভূতির বিপরীতে, হেমন্তকে বার্ধক্য হরণকারী ঋতু হিসেবে আবিষ্কার করেন আর তাই বলেন: ‘হেমন্ত দরোজা ভেঙে নিয়ে আসে সবুজ নিশ্বাস’ যা কিনা বসবাসের নাগরিকতায় দুর্লভ প্রায়। কিন্তু এই সতেজতা ‘মানুষের মতো নয় রক্তে পিত্তে সৌভাগ্য সরল/শিশুটির মতো রাঙা ক্রন্দন ছিটিয়ে চারিপাশে।’ অর্থাৎ এই বিশুদ্ধ বাতাস, নিঃশ্বাসের সঙ্গে উপমিত হলেও, মনুষ্যদৈহিক তো নয়ই, তা রঙিন কান্না চতুর্দিকে ছিটানো শিশুরও অধিক। যেন এ জন্যেই, প্রথম চরণের পরে, হেমন্তে গাছে ‘কৌতুক’ থাকার পুনশ্চ বাণীতুল্য সংবাদটি, অন্তিম চরণেও উচ্চারিত হয়। গাছেই বাঁচার মজা আবিষ্কারের এই ঘটনায় হেমন্ত ঋতু হিসেবে আর নৈর্ব্যক্তিক কিংবা বিমূর্ত থাকে না, নবতর ইতিবাচক বিশিষ্টতা লাভ করে।

হেমন্তের গাছে ‘কৌতুক’ নির্ণয়ের এই অভিজ্ঞতা কি সম্পূর্ণই নতুন? ধনতন্ত্রের বিকাশের এই যুগে হেমন্তকালীন এসব অনুভব পশ্চিমের অনেক কবিলেখকের এসংক্রান্ত আবেগঅনুভূতিআকুতির সঙ্গে কিছুটা হলেও মিলে যায়। যেমন, মনে পড়ে, জর্জ এলিয়ট বলেন: “Delicious autumn My very soul is wedded to it, and if I were a bird I would fly about the earth seeking the successive autumns .” বলা হয়, ইয়োরোপে, পহেলা সেপ্টেম্বর থেকেই হেমন্তের শুরু। হেমন্তে সেখানে ঝাউগাছ ছাড়া আর সব উদ্ভিদেরই বর্ণবিভা ও পাতা ঝরতে শুরু করে এবং শীতের আগেই বৃক্ষকুল পল্লবহীন হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, সেথায় এসময় শস্যোৎসবও নেই। তবু কথাশিল্পী ও কবি জর্জ এলিয়টের কাছে হেমন্ত এতো আনন্দময় ঠেকে কেন? জানার আগেই, তাঁর এবং আমাদের শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধরনেই, সাম্প্রতিক কোনো নাগরিক বাঙালি কবি এই ঋতুর সঙ্গে সংযুক্ত বোধ করেন। উদাস হন এবং এক নিখিল পরিব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে চান।

লেখক : কবিপ্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্রমবর্ধমান অস্থিরতার কারণ উদঘাটন করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধবেকারত্ব সমস্যা ও এর সমাধানের সম্ভাব্য রূপরেখা : আগামী নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি প্রস্তাবনা