হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার কিছু ঐতিহ্যের গাছ

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ২৮ জুন, ২০২২ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

গ্রাম মানে গাছপালা শোভিত একটি চিরায়ত চিত্র। গাছপালার পরতে পরতে আছে অনেকের শৈশবের স্মৃতি। গাছপালা হলো গ্রামীণ সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান। সেই গ্রামের গাছের ছায়ায় রচিত হয়েছে কত না কাব্য, কবিতা ও গল্পকথার ইতিহাস। একসময় গ্রামে এমন সব গাছপালা ছিলো সেগুলো এখন আর চোখে পড়ে না। গ্রামের পথের পাশে, পুকুর পাড়ে, নালা ডোবার পাশে, উঠোনের পাশে কিংবা বাড়ির নানা আঙিনায় এসব গাছের দেখা মেলতো। এই প্রজন্মের অনেকেই এসব গাছের দুএকটি গাছ ছাড়া অন্য গাছগুলো হয়তো চোখেও দেখেনি। ব্যবসায়িক রমরমার এযুগে গ্রামেও গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানায় নানা ধরনের বাগান বাড়ি।

কিন্তু সেখানে সেগুন, আম, কাঁঠাল, জাম, মেহগনি, আমলকি, নিম, জলপাই, জামরুলসহ নানা কাঠের ও ফলের গাছে দেখা মেলে। নার্সারিতেও এখন হাইব্রিড জাতের নানা গাছের চারা পাওয়া যায়। মানুষ নিজের অর্থনৈতিক চিন্তায় এখন গাছ রোপণ করে। এটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু গ্রামে এক সময় যে সমস্ত গাছের দেখা মিলতো সেগুলো সময়ের স্রোতে যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন। সময়ের স্রোতে বন্যা খরা ঘূর্ণিঝড়, কিংবা বয়সের কারণে গাছগুলো প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায় সেগুলোকে আবার রোপণ করে বংশ বৃদ্ধি চেষ্টা কেউ করছে না। ফলে ধীরে ধীরে ওসব গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ গাছগুলোও আমাদের অক্সিজেন দেয়, পরিবেশ ভারসাম্য করে, বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ঔষধে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এগুলো যাতে হারিয়ে না যায় তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।

১.বটগাছ-আমাদের গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি বৃক্ষের নাম বটগাছ। বটগাছ গ্রামবাংলার অঞ্চলের প্রাচীনতম বৃক্ষ। বড় বড় সড়কের মাথায় একসময় বটগাছ ছিলো অপরিহার্য একটি অনুষঙ্গ। গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীরা যাতে ছায়ায় দাঁড়াতে পারে সেজন্য বড় সড়কের মাথায় বটগাছ রোপণ করা হতো কিংবা গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়েও বটগাছের দেখা মেলতো। কালের বিবর্তনে সড়ক প্রশস্তকরণ, যাত্রী ছাউনী নির্মাণ, হাট-বাজারে সরকারি খরচে বাজার বসার জন্য শেড নির্মাণ ইত্যাদি কারণে এসব জায়গায় আজ বটগাছের দেখা মেলে না।

২.অশ্বত্থ গাছ-অশ্বত্থ মূলত এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বৃক্ষ হলেও বর্তমানে এটি সারা বিশ্বে বিস্তার আছে। গৌতম বুদ্ধ এক অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে ধ্যান করার সময় বোধি (জ্ঞান) লাভ করেন। এই স্থানটি বর্তমানে ভারতের বিহারে বুদ্ধগয়ায় অবস্থিত। এজন্য বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অশ্বত্থ গাছের দেখা মেলে। এ গাছের রয়েছে ব্যাপক ঔষধি গুণ। ছায়া দেবার জন্য, মেলা হতো এমন জায়গায়, বাজারে কিংবা বড় রাস্তায় যেখানে পথিক এসে বিশ্রাম নেয় এমন জায়গায় এ গাছের যেভাবে দেখা মিলতো এখন এ গাছের তেমন দেখা মেলে না।

৩.মান্দার গাছ-এ গাছকে কাঁটা মান্দারও বলে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রজাতির মান্দার গাছ দেখতে পাওয়া যায়। কাঁটা মান্দার গাছ পানিয়া মান্দার নামেও পরিচিত। চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘মাদার গাছ’ বা ‘পাইন্যা মাদার’ বলে। দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও এটি বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি পরিচিত উদ্ভিদ। এ গাছ অসংখ্য কালো বর্ণের কাঁটা দ্বারা কাঁটা পরিবেষ্টিত। এ গাছ গ্রামের পানি জমে এমন এলাকার ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠে এবং কেটে না ফেললে অনেক বছর বাঁচে। এ গাছও ধীরে ধীরে গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

৪.জিয়ালভাদি-এই গাছটিকে স্থানীয়ভাবে জিগা বা জিকা, ভাদি, জিয়াল, জিয়ালভাদি, জাটাভাদি ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। চট্টগ্রামের ভাষায় আমরা সচরাচর একে ‘ভাদি’ গাছ বলে থাকি। এই গাছের ডাল কেটে রোপণ করলে তা একসময় জীবিত হয়ে বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। গ্রামে এ গাছের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। বর্তমানে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিত্তবান মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাকা সীমানা দেয়াল দেয়ার কারণে এ গাছেরও সংখ্যা এখন একবারে কমে গেছে। এই গাছের মূল ও পাতায়ও আছে ঔষধি গুণাগুণ।

৫. কদম- এটি ছায়াঘন একটি বৃক্ষ। কদম গাছ ফুলের জন্যও বিখ্যাত। পৌরাণিক ইতিহাস থেকে জানা যায় বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম কদম গাছে উঠে বাঁশি বাজান এবং প্রেমিকা রাধিকাকে আকৃষ্ট করেন। ‘প্রাণ সখীরে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে ?’ এরকম একটি জনপ্রিয় গানও আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বলেছেনে,‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান।’ কদম গাছের ছাল ও পাতা ঔষধ হিসেবেও উপকারী। বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনার কাছে গ্রামের এ গাছগুলোর প্রসার ক্রমে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

৬.পলাশ ফুল গাছ-পলাশ মাঝারি আকারের একটি বৃক্ষ। বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গাতে কমবেশি পলাশ গাছ দেখতে পাওয়া যেতো। কবি নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন-‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/এনে দে এনে দে নইলে/বাঁধব না, বাঁধব না চুল…। এছাড়াও বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গানে এ ফুলের উল্লেখ চমৎকারভাবে-‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো/একটি পলাশ ফুলের মালা…। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন আর এমন আর নান্দনিক সৌন্দর্যের গাছের দেখা মেলে না।

৭.কাঠ বাদাম গাছ-কাঠ বাদাম একটি বৃহদাকৃতির গাছের ফলের বীজ। বীজের নাম অনুযায়ী এই গাছকে কাঠ বাদাম গাছ বলে। গ্রামের রাস্তা ঘাটে পথিকদের ছায়া দেবার জন্য এ গাছ বাজার কিংবা বা চৌ-রাস্তার মোড়ে ব্যাপকভাবে দেখা যেতো। এখন এ গাছটিও বিস্মৃতির অতলে।

৮.আছার গাছ-পিছন্দি একপ্রকার ফল। এই ফলটিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। সারা বাংলাদেশেই বন এলাকার ফল গাছ হলেও গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপক দেখা যেতো। পিছন্দির ফুল ছোট হালকা সুগন্ধযুক্ত। ফলও ছোট। এ গাছের ডাল গ্রামের কৃষকরা একসময় চাষাবাদে গরুকে শাসন করার জন্য ব্যবহার করতো। গ্রামাঞ্চলে এখন এ গাছের এখন দেখাই মেলে না ।

৯.সোনালু গাছ-সোনালু গাছকে বাঁদরলাঠি গাছও বলে। আবার চট্টগ্রামের ভাষায় এক ‘হনালু’ গাছ বলে। গ্রীষ্মে গাছের শাখা-প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালি হলুদ রঙের ফুল ফুটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্মকাল পুরো সময় জুড়ে। হলুদ রঙের ফুল দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সোনালু গাছের বাকল এবং পাতায় ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্যে সেই সোনালু গাছের এখন তেমন দেখা মেলে না। কারণ সংরক্ষণ না করা, পরিচর্যা না করা বা এর গুরুত্বকে তেমন ভাবে উপলব্ধি না করার কারণে এটি এখন প্রায়ই হারিয়েই যাচ্ছে।

সবুজ বনায়নের কথা আমরা সব সময় বলি। পরিবেশ সুরক্ষার কথাও এ সময়ের সবচাইতে আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু সবুজ বনায়নের বাণিজ্যিক ডামাডোলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া এ গাছগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। ব্যাপক ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ এ গাছগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও প্রতীক, আবার গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্যের উপাদানও । সুতরাং এ গাছগুলো যাতে হারিয়ে না যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার টাকায় আমার সেতু
পরবর্তী নিবন্ধ‘হোম ইন দ্য ওর্য়াল্ড’ : অমর্ত্য সেনের আত্মকথা ও বিশ্ববীক্ষা