স্মৃতির আবরণে- মাকে মনে পড়ে
সময় কী দ্রুত এগিয়ে চলে। সেই কবে ছোট বেলায় পড়েছিলাম, ‘টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান’, অর্থাৎ ‘সময় ও স্রোত কারো জন্যে অপেক্ষা করে না’। কেবল সময় এবং স্রোত বলি কেন? কেউ কি কারো জন্যে অপেক্ষা করে? করে না। যার যার সময় যখন হবে, তখন সে বিদায় নেবে। জন্মের মধ্যে দিয়ে যার শুরু, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তার পরিণতি। এটি অবধারিত। মনুষ্যপ্রাণী থেকে শুরু করে প্রতিটি জীবজন্তু, প্রাণী, এমন কী এই জগতের গাছপালা, নক্ষত্রও। এটিই জাগতিক নিয়ম। এটিই আমাদের মেনে নিতে হবে, মেনে নিতে হয়। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে আজকের এই দিনটিতে (১৩ জানুয়ারি ২০১০) আমি চাটগাঁয়। বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরবো, ঢাকা থেকে ভোর রাতে হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ। সবকিছু ঠিকঠাক, ‘দুয়ারে দাঁড়ায়ে গাড়ি প্রস্তুত’ অনেকটা তেমন। দেশে গিয়েছিলাম বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ মাকে দেখতে। মা’র অসহ্য শারীরিক কষ্ট, সে কষ্টের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। দাদা, দিদি ফোনে বলেন, ‘তুই একবার এসে দেখে যা, তোর জন্যে মা মনে হয় অপেক্ষা করছেন’। ইতিমধ্যে ছোটভাই সঞ্জয় বেলজিয়াম থেকে এসে মাকে দেখে গেছে। ছুটে গেলাম। যে মা সারাটা জীবন কেবল নিজ স্বামী ও সন্তানদের জন্যে নয়, নিকট-দূর আত্মীয়-স্বজন ও পরের জন্যেও নিজের সুখ, সময় অকাতরে বিসর্জন দিয়েছেন, সেবা করেছেন সেই মা নিজ-কষ্টে বিছানায় শুয়ে। আমরা অসহায় তার ক’টি সন্তান বিছানার চারপাশ দাঁড়িয়ে। তার কষ্টে কষ্ট পাই। কিন্তু কী অবাক করা, মাকে একবারও বলতে শুনলাম না, কষ্ট পাচ্ছি। পাছে আমরা কষ্ট পাই, এই ভেবে হয়তো। এমনটিই ছিলেন আমরা ছয় ভাই, দু-বোনের এই মা। বিকেলে ঢাকা রওনা দেবার আগে কে সি দে রোডে এক পরিচিত ওষুধের দোকান থেকে কিছু কটন ও ওষুধ নিয়ে এলাম। মা তখন দাদার বাসায়। এসে দেখি কম্পউন্ডার মায়ের ‘ড্রেসিং’ করছেন। একদিকে সোফা আর চেয়ারে বসা আমার বন্ধু, ইউনুস, ঢাকা থেকে আসা দিদি এবং দাদার বন্ধু, দৈনিক আজাদীর লেখক ডা. দুলাল দাশ। ডা. দাশ মাকে নিয়মিত দেখতে আসতেন, তিনি আমাদের পারিবারিক সদস্যের মত। দিন দুয়েক আগে মায়ের এই শারীরিক কষ্ট দেখে দিদি আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুই মাকে বিদায় দে, তোর জন্যে মা বিদায় নিতে পারছেন না’। হয়তো এসব কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাস। আমার তাতে খুব একটা বিশ্বাস নেই। তারপরও রাতে মনে মনে মাকে বিদায় দেই, মায়ের অসহ্য কষ্ট থেকে মুক্তির জন্যে। সে বিদায় দিতে গিয়ে মনে মনে যুদ্ধ করেছি। কোন সন্তান কি চায় তার মাকে চিরতরের জন্যে নিজ থেকে বিদায় দিতে। এ যেন ধরে-রাখা হাতের বাঁধন খুলে দেয়া। কষ্ট হবে জেনেও মাকে মায়ের কষ্ট থেকে মুক্তির জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানাই, ‘মাকে আর কষ্ট দিও না, এই যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দাও’। আমার মনের কথা ‘উনি’ কি শুনেছিলেন? ওষুধ ও কটন নিয়ে বাসায় আসার খানিকবাদেই মা চলে গেলেন। চিরদিনের তরে। আমার আর হল্যান্ড ফিরে আসা হলো না। সে ছিল ১৩ জানুয়ারি। মা’র চলে যাবার দিন।
মা ছিলেন দেখতে ভীষণ সুন্দর। হবেনই বা কেন। তার মা বাবা দুজনেই ছিলেন সুন্দর। বাবা যখন বিয়ে করে মাকে গ্রামের বাড়িতে তুললেন, তখন নাকি গ্রামের, এমন কী আশপাশ গ্রামের মহিলারা দেখতে আসতো। বলতো, কই, ‘বিধুর বৌ নাকি খুব সুন্দর, তাকে দেখতে এলাম’। বয়সকালেও মায়ের সৌন্দর্য্য ছিল দেখার মত। অথচ মাকে কখনো সাজতে দেখিনি। বড়জোর স্নো-পাউডার আর চোখে কাজল। মায়ের সহ্য ক্ষমতা ছিল প্রবল। মৃত্যুর আগে যখন প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট পাচ্ছিলেন তখনও কখনো তাকে ব্যথায় এতটুকু কাতর হতে দেখিনি। অথচ আমরা, এই আমি, একটু মাথা বা পেট ব্যথা হলে সারা ঘরে হুলুস্থূল ফেলে দিতাম। মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। বিছানায় শুইয়ে মাথা খাটের বাইরের দিকে রেখে বালতি এনে পানি ঢালতেন, পরম যত্নে গামছা বা টাওয়েল দিয়ে মাথা ভালভাবে মুছে দিতেন। বাসার সামনেই ছিল নিজেদের বড় মাঠ। সেখানে আমরা স্কুল বয়সে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতাম। অনেক সময় রাতে পায়ে ব্যথা। মা তেল লাগিয়ে মালিশ করতেন। কেবল কী আমার জন্যে। সব ক’টি ভাই-বোন এবং বাবার জন্যে। কিন্তু মাকে দেখিনি কারো কাছ থেকে কোন সেবা নিতে। আমরা সব ক’টি ভাইবোন, বোধকরি নিজেরা নিজেদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। বাবার সরকারি বড় আকারের বাসাটি ছিল রেলওয়ে স্টেশনের কাছাকাছি। ফলে গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজন, সে নিকট হোক, দূর হোক, কারো চিকিৎসা, কারো চোখ অপারেশন, কারো মেট্রিক পরীক্ষা সেন্টার পড়েছে শহরে, অতএব মাসব্যাপী আমাদের বাসায় তার ঠিকানা, কোর্টে মামলার হাজিরা দিতে হবে, দলবল, সাক্ষী সহ দাদু আমাদের বাসায় দিন কয়েক খাওয়া-দাওয়া-থাকা। বাবার সরকারি বাসটি ছিল যেন আক্ষরিক অর্থে ‘লঙ্গরখানা’। এর বাইরে তো আছে শহরের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিত্য আসা-যাওয়া। এখন ভাবি কী করে সম্ভব হয়েছিল বাবার একার পক্ষে এতকিছু, এতো ঝড়-ঝামেলা সামাল দেয়া। অবশ্য ঝড় যা বয়ে যাবার সে বয়ে যেত মায়ের উপর দিয়ে। মাকে মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে বলতে শুনতাম, ‘এত বড় জাহাজটাকে যে কী করে সামলাচ্ছি সে আমি জানি’। আসলেও তাই। বাবা ছিলেন ত্যাগী, সৎ ও একনিষ্ট সরকারি চাকুরে। অফিস আর কাজের মাঝে ডুবে থাকতেন। আমাদের পাড়ায় বাবার অফিস কলিগরা যখন সন্ধ্যায় মাঠে বসে বা বাসায় আড্ডা দিতেন তখন বাবাকে দেখেছি মাথা গুঁজে অফিস থেকে নিয়ে আসা একগাদা ফাইল খুলে কাজ করতে। বাবা চাইলে আমাদের স্বর্গসুখে রাখতে পারতেন। কিন্তু সে ‘উল্টো-পথের’ কাজটি বাবা করেননি। পাড়ার এক লোকের নাম উচ্চারণ করে বাবা বলতেন, ‘রাতে যদি কোন গাড়ি এসে ওর বাসার সামনে দাঁড়ায়, ও পর্দা উল্টিয়ে প্রথমে দেখে গাড়িটি পুলিশের কিনা। আমাদের তো সে ভয়টি নেই। সৎ পথে চলার এই নিরাপত্তা’।
অতিথি এলে বাবা চায়ের অর্ডার দিয়ে আড্ডায় মেতে যেতেন। বাবা তো বলেই খালাস। এদিকে সমস্ত অতিথি, আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা, খাওয়া-দাওয়া, কারো বিয়ে, কারো সন্তান হবে ইত্যাদি সব সামাল দিতে হতো মাকে। এমনও হয়েছে আমাদের কখনো, হঠাৎ অতিথি এসেছে অসময়ে। বাসায় চিনি নেই। তড়িঘড়ি করে পেছনের দরোজা দিয়ে মুকুল আপাদের বাসা। সেখান থেকে এক কাপ চিনি এনে পরে ‘রেশন’ তুলে তা ফেরত দেয়া। এত অতিথি, এত আত্মীয়-স্বজন, প্রতিটি দিন। মাকে ১৩ জানুয়ারি ‘শববাহী’ গাড়ি করে এনে এনায়েত বাজার বৌদ্ধ মন্দিরের মাঠে রাখা হয়েছে। লোকের ভীড়। সবাই শোকাহত। খবর পেয়ে মুকুল আপা ছুটে এলেন মাকে শেষবারের মত দেখতে। বৌদ্ধ মন্দিরের একপাশে বসে তিনি বললেন, ‘মাসিমাকে দেখেছি সারাদিন রান্নাঘরে থাকতে। তোদের রান্নাঘরের চুলোয় চায়ের যে কেতলি ছিল সেটিকে কখনো নামতে দেখিনি, কেননা একজনের পর একজন গেস্ট লেগেই ছিল’। বাবার সরকারি বাসাটি ছিল যেন ‘সেবাসদন’। শহরে কারো থাকার আশ্রয় নেই, নো প্রবলেম। মাকে ‘দিদি’ কিংবা ‘মাসি’ ডেকে বাসায় ঢুকে বলে, ‘আর তো কোথায়ও যাবার জায়গা নেই। কিছুদিন থাকতে হয় যে’। এক ভদ্রলোক, মামার গ্রামের লোক, তার শহরের ছোটোখাটো ব্যবসা লাটে উঠেছে। ছোট একটা আলমিরা, কোথায় নেবে। সেটি এনে ‘দিদি, কিছুদিন এখানে থাক’, বলে সেই যে গেলেন সেটি আর ফেরত নেবার নাম গন্ধ ছিল না অনেক বছর। মা-বাবা কেউ ‘না’ বলতে পারতেন না। কাউকে কোনদিন ‘না’ করতে দেখিনি। যেই আসুক না কেন হাসিমুখে খাইয়েছেন, আদর-যত্ন করেছেন। বাবা বলতেন, ‘সবার কাছে সবাই আসেন না, আর অতিথি হচ্ছে লক্ষ্মী’। আমাদেরও কোন সমস্যা হতো না। আমাদের বড় হয়ে উঠা যে ঐভাবেই, সবার সাথে সব কিছু ‘শেয়ার’ করে। আর তাই অতিথির সংখ্যা বাড়লে রাতে আমরা অনেক সময় আমাদের বাসায় ভিন গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা যে ছেলেটি বড় হয়েছে এবং বাবা যাকে এক সময় তার অফিসে পিয়নের চাকরি দিয়েছেন এবং যাকে আমরা ছোটবেলা থেকে কাকা বলে এসেছি, তার সাথে একসাথে ফ্লোরে বিছানা পেতে মশারির ভেতর শুয়েছি একই বিছানায়। কোনো সমস্যা হয়নি আমাদের। এছাড়া আমাদের বাসায় ছিলেন মায়ের মেজভাইটি। তাকেও বাবা চাকরি দিয়েছিলেন রেলওয়েতে। সুদর্শন এই মেজ মামা থাকতেন ঘরে ঢুকতেই ডানদিকে, একটি খাট পেতে। বিয়ের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমাদের সাথে। ছিলেন বেশ কিছুদিন দিদির জামাই। বাবা তার জন্যে পৃথক ঘর বরাদ্দ করলেন। জামাই, তাই বাড়তি খাতির। তার কামরায় রেডিও শোনার জন্য অফিসের মিস্ত্রি ডেকে ইলেকট্রিক কানেকশন দিলেন। তখন টিভি খুব একটা ছিল না। আমাদের পাড়ায় কেবল আমাদের পাশের বাসায় ছিল টেলিভিশন। আমাদের কোন সমস্যা হলো কিনা মা-বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। আজ ভাবতে অবাক লাগে, আমরা ভাই-বোনেরা তাতে কোন সমস্যা হয়েছে বলে কখনো মনে করিনি, কিংবা সামান্যতম উষ্মাও প্রকাশ করিনি। বুঝি এটিই নিয়ম, এমনই হওয়া উচিত বলে ধরে নিয়েছিলাম। এই ছিল মা-বাবার শিক্ষা, আমাদের জন্যে। আজকের দিনে এমনটি কল্পনাও করতে পারিনে।
মাকে খুব মনে পড়ছে। ক’দিন ধরে বিছানায় শুতে গিয়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াই কবে মাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘মা তুমি খেয়েছো’? খুঁজে পেলাম না। আমার মা সহ পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। মাকে নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করবো এই লেখা- ‘কোন মা-ই ভেজা বিছানায় শুতে চাইবে না না, কিন্তু শুকনো বিছানাটি সন্তানের জন্যে রেখে প্রয়োজনে তিনি হাসিমুখে সেই কাজটি করবেন’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট