‘কেউ বলে ফাগুন/ কেউ বলে পলাশের মাস/ আমি বলি আমার সর্বনাশ,/ কেউ বলে দখিনা/ কেউ বলে মাতাল বাতাস,/ আমি বলি আমার সর্বনাশ’- এমন ‘সরল’ কথাটা যিনি গানে গানে বলেছেন তার নাম জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ফাগুন তখনও আসেনি, বসন্তও না। তাতে কী! তখন আমাদের এখানে অর্থাৎ ইউরোপে ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক এখন বসন্ত’ এই ভাবনার উপর ভর করেই আয়োজন চলে গায়ে বসন্তের রং চড়ানোর আয়োজন। আর এতে স্বাভাবিকভাবে মহিলারা এক নয়, কয়েক ধাপ এগিয়ে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি বা শেলোয়ার-কামিজ, মাথায়, হাতে চুড়ির সাথে বাসন্তী রঙের ফুল পেঁচানো, মেহেদী রাঙানো হাত যতটুকু দেখা যায় তক, কপালে টিপ লাগিয়ে ইউরোপের এই হাড়-কাঁপানো শীতেও এক হয়েছে কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার। উপস্থিত মহিলারা সবাই নিজ নিজ ঘর থেকে বানিয়ে এনেছেন হরেক রকমের পিঠা। ভাপা, চিতল, পাটি সাপ্টা থেকে শুরু করে আমার নাম না-জানা অনেক পিঠা। বলা বাহুল্য পিঠা এখানে মুখ্য নয়, মুখ্য এক-হওয়া ও গায়ে বসন্তের পোশাক চড়ানো এবং তার সুরভি ছড়ানো। অর্থাৎ ফেইস বুক সহ নানা সামাজিক মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই আপ-লোড করা। সবাইকে জানান দেয়া। কেবল পিঠাই নয়, পিঠার পর রয়েছে টেবিল ভর্তি সান্ধ্য-খাবারের আয়োজন। চলে আড্ডা, অনেক রাত অবধি। দু’ভাগে ভাগ হয়ে। মহিলারা বড়সড় ড্রয়িং রুমের একদিকে, পুরুষরা অন্যদিকে। মহিলাদের আড্ডায় বিষয় কী জানা নেই। পুরুষদের আড্ডায় হলিউডের ছবি, বাংলাদেশসহ নানা বিষয়ের সাথে উঠে আসে ইউক্রেন প্রসঙ্গ। কেউ কেউ জানতে চায়, রাশিয়া কি আসলেই ইউক্রেন আক্রমণ করবে? নাকি এসব কেবল হুমকি-ধামকি? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের লম্ফ-জম্প মাত্র? কথায় আছে যত গর্জে তত বর্ষে না।
আসলে কি তাই? বলা মুশকিল? সত্যি কথা বলতে কী এই মুহূর্তে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা মুশকিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে রাশিয়া যদি তার গলা সপ্তমে চড়ায়, যুক্তরাষ্ট্র অষ্টমে, ন্যাটো আর এক ধাপ এগিয়ে আরো উঁচুতে। তবে এটি সত্যি যে স্থলপথে রাশিয়া তার প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, দুর্বল ও স্বাধীন রাষ্ট্র ইউক্রেনকে তিন দিন থেকে ঘিরে রেখেছে তার দেড় লক্ষ সেনাবাহিনী সদস্য সহ প্রচুর সামরিক সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে। জলপথেও চলমান রাশিয়ান যুদ্ধ জাহাজ। চলছে মহড়া। রাশিয়া শুরু থেকে দাবি করে আসছে এ কেবল ‘আমাদের নিয়মমাফিক মহড়া। ইউক্রেন আক্রমণ করা বা দখল করার কোন খায়েশ আমাদের নেই।’ কিন্তু রাশিয়ার এই আশ্বাসে বিশ্ববাসীর কতটুকু বিশ্বাস আছে? কথায় আছে ‘গোয়াল পোড়া গরু সিঁদুর দেখলে ভয় পায়।’ বছর কয়েক আগে ইউক্রেনের উপদ্বীপ, ক্রিমিয়া গায়ের জোরে নিজের করে নিয়েছে ক্ষমতাধর রাশিয়া। সে সময় ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা ইউরোপ ‘হেন্ করেংগা, তেন করেংগা’ বলে অনেক গলাবাজি করেছিল। কিন্তু ওই তক। রাশিয়া সেই হুমকিকে আমলেই নেয়নি। সে সময় রাশিয়ার প্লাস পয়েন্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় তখন পুতিনের কাছের মানুষ, ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোন এক অদৃশ্য কারণে ট্রাম্প পুতিনকে ক্ষেপাতে সাহস করতেন না। কোথায়ও যে তার দুর্বলতা আছে সে অনেকের জানা। কদিন আগে ট্রাম্প বলেন, ‘পুতিন আমার বন্ধু, তিনি আমাকে বুঝেন, আমি তাকে বুঝি। আমি এই সময় ক্ষমতায় থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না।’ শুনে আমাদের জমপেশ আড্ডায় উপস্থিত একজন বলে উঠেন ‘বটে’।
আড্ডায় তরুণ বাংলাদেশি এক্সপেট হাসিব আজিজ প্রশ্ন করেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলে কার কী ক্ষতি হবে কিংবা ইউক্রেন-সীমান্তে নিয়োজিত রুশ-সেনাবাহিনী ফিরে না গেলে কার লাভ বা ক্ষতি হবে? উত্তরে বিজ্ঞের ভান করে উপস্থিত এক সাংবাদিক বলেন, ইউক্রেন ও ইউরোপের ক্ষতির চাইতে ‘বড় ক্ষতি’ আশংকা করছেন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেনের পতন হলে তার (বাইডেন) যে রাজনৈতিক পতন ঘটবে তা অনেকটা নিশ্চিত। ক্ষমতায় বসার পর থেকে জো বাইডেন করোনা, মেঙিকো বর্ডারে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধেঁয়ে আসা শরণার্থীর ঢল, অর্থনীতি ইত্যাদি ইস্যুকে ঘিরে বেশ বেকায়দায় রয়েছেন। এই সমস্ত সমস্যা ছাড়া যে সমস্যাটি ‘বিষ ফোঁড়ার’ মত রয়ে গেছে তা হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতার বাইরে থেকেও ট্রাম্প এখনো রিপাবলিকান পার্টির চাবিকাঠি ঘুরাচ্ছেন, এককভাবে এবং অনেকটা সফলভাবে। চলতি বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্বতীকালীন নির্বাচন। ইতিমধ্যে তার (বাইডেন) জনপ্রিয়তা বেশ হ্রাস পেয়েছে এবং ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন তা অনেকটা নিশ্চিত। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা নিজ দলে এখনো ঊর্ধ্বমুখী এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাকে কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই মনে করেন রাশিয়াকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে জো বাইডেন তেমন ‘শক্ত’ নন। সে কারণে তিনি যদি রাশিয়াকে ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হন, তাহলে মার্কিন জনগণের কাছে তিনি একজন দুর্বল প্রেসিডেন্ট হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং তার খেসারত যে তাকে ২০২৪ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দিতে হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখনো পর্যন্ত তিনি ইউক্রেনে রুশ হামলা ঠেকাতে পুতিনকে রাজি করাতে পারেননি। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি ইতিমধ্যে তাকে দুবর্ল নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। বোধকরি সে কারণে জো বাইডেন ও বাইডেন প্রশাসন রাশিয়াকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে বলে বেড়াচ্ছে রাশিয়া যে কোনদিন, যে কোন মুহূর্তে ইউক্রেন আক্রমন করতে পারে এবং তেমনটি হলে রাশিয়া কল্পনাও করতে পারবে না তেমন পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও পশ্চিমা বন্ধু রাষ্ট্রগুলি। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়াকে ‘দ্রুত ও সন্দেহাতীতভাবে’ সাজা দেবে। তবে রাশিয়া বরাবরই বলে আসছে হামলা চালানোর কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। এ ধরনের অভিযোগকে ‘উস্কানিমূলক’ বলে উল্লেখ করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে কিয়েভ থেকে তার কূটনৈতিকদের সরিয়ে ফেলেছে এবং তার পদাংক অনুসরণ করে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিও দূতাবাস থেকে তাদের লোকবল সরিয়ে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় ইউক্রেনও। এমনকি অনেক ইউক্রেনবাসীও মনে করেন না যে যুদ্ধ আসন্ন এবং তাদের ধারণা রাশিয়া তাদের দেশ আক্রমণ করবে না। যদিও বা তেমনটি যদি ঘটে সে সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস গত সপ্তাহে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে ফোনালাপকালে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে আলোচনার মধ্যে দিয়ে বিরাজমান সমস্যার সমাধান সম্ভব। একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন পুতিন ও জার্মানির নুতন চ্যান্সেলর ওলফ শোলজ। আয়রন লেডি হিসাবে পরিচিত জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেল ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে সোলজ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর হিসাবে ক্ষমতায় বসেন। ইউক্রেনের উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে তিনি চলতি সপ্তাহে মস্কো সফর করেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে আলাপ করেন। আলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দুই নেতাই বলেন, তারা কেউ চাননা ইউরোপে আর একটি যুদ্ধ হোক। তারা মনে করেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভবা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক ফোনালাপে একই আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ইউক্রেন সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। সংকট সমাধানে এখনো একটি সমঝোতা সম্ভব। মস্কো ইতিমধ্যে সীমান্ত এলাকা থেকে কিছু সেনাবাহিনী ও সমরাস্ত্র ফিরিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করে, যদিও বা যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউক্রেন ‘এই দাবির কোন ভিত্তি নেই’ বলে জানায়। মোদ্দাকথা, বিশ্বাসের অভাব। ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র যেমন রাশিয়াকে বিশ্বাস করছে না, ঠিক তেমনি রাশিয়াও মনে করে ন্যাটো তাদের ঘরের দুয়ারে এসে পড়েছে, তাদের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে রাশিয়া দাবি জানিয়েছে ইউক্রেন কোনভাবেই ন্যাটোর সদস্য হতে পারবেনা। রাশিয়ার এমন দাবিকে সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাক না কেন, দিন কয়েক ধরে মনে হচ্ছে বরফ কিছুটা হলেও গলতে শুরু করেছে। রাশিয়ার ‘টোন’ কিছুটা নমনীয় বলে আপাত: প্রতীয়মান হচ্ছে। দেখা যাক সামনের দিনগুলিতে ঘটনার মোড় কোনদিকে নেয়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট