স্ট্যান্ডস্টেড। বৃটেনের একটি এয়ারপোর্ট। এর নাম কেউ কেউ হয়তো শুনে থাকবেন। তবে অনুমান করি অনেকেই শুনেননি। শুনে না থাকলে একথা ভাবার কোন কারণ নেই যে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল। নামটি আমার জানা থাকলেও এই বিমানবন্দর হয়ে কখনো বিলেতে নামা হয়নি। হল্যান্ড আছি একটানা তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে। ইতিমধ্যে অনেকবার যাওয়া হয়েছে উত্তর সাগর পাড়ের ওধারে, ইংরেজদের এই দেশে। তবে সাগর পাড়ি দিয়ে আমার সে–দেশে যাওয়া হয়েছে কেবল একবারই। সে একানব্বই সালে, হল্যান্ড আসার মাস কয়েক পর। এরপর যখনই যাওয়া হয়েছে গেছি আকাশপথে, উড়োজাহাজে। হিথ্রো এয়ারপোর্ট হয়ে। বিশাল এই হিথ্রো। প্লেন থেকে নেমে লাগেজ–বেল্ট পৌঁছুতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর –দুটোই। আর এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে হলে তো কপালে আরো দুর্ভোগ। ইংল্যান্ডের সব চাইতে বড় বিমানবন্দর এই হিথ্রো। এরপর গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট। তৃতীয় অবস্থানে আছে শুরুতে যে বিমানবন্দরের কথা উল্লেখ করেছি তার, অর্থাৎ স্ট্যানস্টেড এয়ারপোর্ট। লন্ডন নগর থেকে বেশ দূরে। এই এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে চড়ে লন্ডন পৌঁছুতে সময় লাগে পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট। পঞ্চাশ মিনিট মানে পঞ্চাশ মিনিট। বাংলাদেশের মিনিটের হিসেব না করলেই ভালো। ইউরোপে সবকিছু চলে সময়ের কাঁটা ধরে। আমাদের অর্থাৎ আমি, আত্মজ অতীশ ও তার মা ঢাউস–সাইজের কোচে লন্ডন থেকে স্ট্যান্ডস্টেড এয়ারপোর্ট পৌঁছুতে সময় লাগলো মিনিট পঞ্চাশ। চমৎকার এই কোচ। প্রতিটি সীটের পেছনে ক্যামেরা, মোবাইল চার্জ দেয়ার রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। কোচ ছাড়ার আগে প্লেনের মত ঘোষণা– সিট বেল্ট পড়ুন, দুর্ঘটনা ঘটলে কোন দরোজা দিয়ে বের হতে হবে তার নির্দেশনা ইত্যাদি ইত্যাদি। ভালোই লাগলো এই পথটুকু। কোচের খবর, এমন কী ঝক্কি এড়ানোর জন্যে হিথ্রো না নিয়ে স্ট্যান্ডস্টেড বেছে নেয়া, বিখ্যাত স্ট্রাটফোর্ড এলাকায়, ওয়েস্টফিল্ড শপিং কমপ্লেক্সের কাছেই চমৎকার হোটেল বুক–করা সবই রেখেছিল অতীশ, উৎসাহের সাথে, আমার হল্যান্ড পৌঁছার সপ্তাহ খানিক আগে। দেশ থেকে ফিরে দিন দশেকের মধ্যে উড়াল দিতে হয়েছিল লন্ডন। বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য বেড়ানো নয়। কাজ ,তবে কাজ শেষে আরো দিন তিনেক থেকে গিয়েছিলাম। বেড়ানো আমার কপালে নেই। সে সময়টায় আমার বেড়ানো তেমন হয়নি। বাকি সময়টুকুর অনেকটা হোটেলে বসেই কাজ সারতে হয়েছে। বেড়িয়েছে কিছুটা অতীশ, বেশিরটা তার মা। যাই হোক–
স্ট্যান্ডস্টেড এয়ারপোর্ট কেমন হবে, ভালো লাগবে কিনা কিংবা ঝক্কি–ঝামেলা হবে কিনা এই সব নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু নেমে ভালো লাগলো। বেশ পরিষ্কার। যতটা ছোট হবে না–জেনে ধরে নিয়েছিলাম, দেখলাম তার চাইতে অনেক বড়। পরে জেনেছি ইংল্যান্ডে হিথ্রো ও গ্যাটউইকের পর স্ট্যান্ডস্টেডের অবস্থান। ২০১৭ সালে এই বিমানবন্দর হয়ে আড়াই কোটিরও বেশি যাত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেন বলে প্রকাশ। ইউরোপীয় পাসপোর্টের কল্যাণে রিডেবল মেশিনে পাসপোর্ট খুলে ধরতেই গেইট খুলে গেল। এইটাই ইমিগ্রেশন। কোন প্রশ্ন নেই, ধারে–কাছে কোন কর্মচারী নেই। বিশাল হলের মনিটরে কয় নম্বর বেল্টে আমাদের লাগেজ আসবে, তা দেখে সেদিকে এগিয়ে যাই। অতীশ গেলো লন্ডন–গামী কোচের টিকেট কাটতে। ক্ষণিক বাদে বেল্টের উপর দেখা গেল আমাদের ব্যাগ। মিনিট পনের পর–পর কোচ ছাড়ে লন্ডনের উদ্দেশে। ঠিক হলো কিছু খেয়ে নেয়াই ভালো হবে। ইতিমধ্যে লাঞ্চেরও সময় হয়ে এসেছে। সুমনা না খেতে পারলে বাঁচে। অন্যদিকে আমার আর অতীশের চা–কফির সাথে ‘সলিড’ কিছু না খেলে না–বাঁচার দশা। চিকেন স্যান্ডউইচ, চা খেয়ে কোচের দিকে এগিয়ে যাই। তখন যাত্রীরা প্রায় সবাই উঠে বসেছে। আমাদের বড় ব্যাগ কোচের নিচে যে বিশাল লাগেজ স্পেস সেখানে ঢুকিয়ে দিলেন কোচের এক কর্মচারী। সামনের সব সিট তখন দখল হয়ে গেছে। কোচের পেছনের দিকে কয়েকটি ছিল খালি। ল্যাপটপ ও হাতের ব্যাগ ‘ওভারহেড বিনে’ রেখে গায়ের ভারী কোটটা খুলে নেই। বাইরে ঠান্ডা লাগলেও ভেতরে ঠিক তার উল্টো। বাস ধীর গতিতে এগিয়ে চলে। কোন তাড়া নেই, কোন ওভারটেক নেই। বাংলাদেশে তো বাস–কোচে উঠলে ‘জান’ হাতে নিয়ে বসতে হয়। মনে মনে ‘দোয়া ইউনুস’ পড়তে হয়। তারপর যাত্রা শুরু করলো তো গাড়ি একবার ডানে আর একবার বামে করতে করতে আপনাকে পৌঁছে দেবে নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে। কপাল মন্দ হলে হাসপাতালে, কপাল যদি আরো খারাপ হয় একবারে ‘উপরে’। আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুঝে সামনের দিনগুলির কাজের কথা ভাবতে থাকি। আর মাঝে মাঝে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডকে দেখতে থাকি।
অনেকদিন পর লন্ডন আসা। কোভিডের পর এদিকটায় আর আসা হয়নি। লন্ডনে এখন কিছুটা উৎসব–উৎসব ভাব। যেদিন এই লেখা ছাপার অক্ষরে বের হবে অর্থাৎ ৬ মে, সেদিন রাজা চার্লস তৃতীয়ের রাজ্যাভিষেক। তার মা রানী এলিজাবেথ মারা যাবার পর চার্লস ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সিংহাসন আরোহণ করেন। এবারের রাজ্যাভিষেকের একটি উল্লেখ করার মত বিষয় এই যে, অনুষ্ঠানে ভারতীয়–বংশোদ্ভূত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল থেকে কিছু অংশ পাঠ করবেন। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ অফিস জানায়, অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মতো এই জাতীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবেন। অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা শেষে রাজা ইহুদি, হিন্দু, শিখ, মুসলিম ও বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিদের দ্বারা সম্মিলিতভাবে দেওয়া একটি ‘উচ্চারিত–অভিবাদন‘ গ্রহণ করবেন। অনুষ্ঠান হবে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে, যার আদি নাম, ওয়েস্টমিনস্টারে কলেজিয়েট চার্চ অফ সেন্ট পিটার। ইংরেজ–ইতিহাসে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই ১০৬৬ সাল থেকে এই চার্চে ৩৯ ইংরেজ ও বৃটিশ রাজা–রানীর রাজ্যাভিষেক হয়েছে, ১০৬৬ সাল থেকে অ্যাবেতে অন্তত ১৬টি রাজকীয় বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, এছাড়া ১৮ ইংরেজ, স্কটিশ ও বৃটিশ রাজার সমাধিস্থল এই চার্চের ভেতর। এতক্ষণ তো কেবল রাজা চার্লসের কথাই বললাম। ক্যামিলা পার্কারের কথা বাদ দেই কী করে? তিনি তো আর এখন কেবল রাজা চার্লসের জীবনসঙ্গীনি নন, তিনিও অভিষিক্ত হবে রাণী হিসাবে। রাণী হিসাবে তাকে বৃটিশ জনগণের কতভাগ মেনে নেবেন বা গ্রহণ করবেন সেটি দেখার বিষয়। অনেকে তাকে কিছুতেই তাদের হৃদয়ে স্থান দেয়া প্রিন্সেস ডায়ানার স্থলে বসাতে রাজি নন। আমি তো বৃটিশ নাগরিক নই, ইংরেজ তো নই–ই। সেদিন অর্থাৎ যেদিন লন্ডন থেকে হল্যান্ড ফিরবো এক শপিং মলের সুভেনিয়র– শপে গিফট কিনতে গিয়ে রানী এলিজাবেথের ছবি–সম্বলিত দুটি কাপ ও প্লেট কেনার পর, যে মহিলা বিক্রি করছিলেন, চার্লসের ছবি সম্বলিত একটি কাপ দেখিয়ে তা কিনবো কিনা জানতে চাইলে, মৃদু হেসে তাকে বলি, ওটা তোমার কাছে রেখে দাও, উনি আমার রাজা না, পছন্দেরও না। সে–দোকানে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি সহ নানা ধরনের গিফট দেখলাম, কিন্তু হবু রানী ক্যামিলা পার্কারের ছবি সহ কোন গিফট চোখে পড়লো না। এতেই অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়না তার (ক্যামিলা) জনপ্রিয়তা কোথায়। রাজ্যাভিষেককে ঘিরে লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে কিছু সাজগোজ করা হয়েছে, ব্যানার, ফেস্টুনও চোখে পড়ে। তবে কোথাও নেই এতটুকু বাড়াবাড়ি। আমাদের দেশে ইউনিয়ন কউন্সিল নির্বাচনে কোন প্রার্থী জিতলে এর চাইতে অনেক বেশি ফেস্টুন, ব্যানার, ছবি, পোস্টার চোখে পড়ে। আমাদের তো সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।
রাজা চার্লসের বয়স এখন পঁচাত্তর। তার মা, এলিজাবেথ যখন রাণী হিসাবে সিংহাসন আরোহণ করেন তখন চার্লসের বয়স ছিল মাত্র চার। তার জীবনে ঘটছে নানা ঘটনা, কেলেঙ্কারি, বিচ্ছেদ, বেদনা। প্রিন্সেস ডায়ানাকে বিয়ে করেন ১৯৮২ সালের ২৯ জুলাই, কিন্তু দুই সন্তান (উইলিয়াম ও হ্যারি) জন্মের পর ১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের টিভি বা বড় পর্দায় উপভোগ করা বিয়ে ভেঙে গেল বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে। মারা গেলেন প্রিন্সেস ডায়ানা প্যারিসে, ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট এক সড়ক দুর্ঘটনায়। সেই দুর্ঘটনাস্থলে একবার গিয়েছিলাম কৌতূহলবশত। এরপর সমস্ত জল্পনা–কল্পনা অবসান করে ২০০৫ সালে ৯ এপ্রিল চার্লস ও ক্যামিলা পার্কারের বিয়ে হলো। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি আগামীর দিকে। নতুন রাজা কেমন শাসন করেন রাজ্য তা দেখার অপেক্ষায় অনেকে, যদিও রাষ্ট্রের নানা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া তার সত্যিকার অর্থে আদৌ কোন ক্ষমতা আছে কিনা সেটিও দেখার বিষয়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট