আরব সাগর ও লোহিত সাগরের মাঝে আফ্রিকার যে অংশটি শিংয়ের মতো দেখতে সেটিই সোমালিয়া। চিরকালই দারিদ্রের শিকার এই দেশটি। তবে বিগত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে তা চরম আকার ধারণ করে। ১৯৯৫ সালে দেশের স্বৈরাচারী শাসক মহম্মদ সৈয়দ বারের মৃত্যুর পর দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। চরম অর্থ সঙ্কট দেখা দেয় দেশ জুড়ে। তার ফলশ্রুতি হিসাবেই সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুদের উত্থান ঘটে, যা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভীষিকার পরিণত হয়।
ওই একই সময়ে ইউরোপীয় মাছ ধরার জাহাজগুলি সোমালিয়ার উপকূলে ভিড় করতে থাকে। সেখান থেকে মাছ লুট করে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে তাদের। এতে স্থানীয় জেলেরা জীবিকাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। ধীরে ধীরে তারা নিজেরাই এই লুট রুখতে তৎপর হন। এক পর্যায়ে তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সামপ্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাছাড়া, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি।
বিবিসি বাংলা জানায়, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি। কিন্তু গত কয়েকমাসে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা তাদের মতে, গত বছরের নভেম্বরে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালি উপকূলে অন্তত ১৪ টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে। ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়। এখনও জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি আছেন ১৭ জন ক্রু।
জানুয়ারিতে, ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহে তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানি নাগরিক বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয় ‘এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দী ছিলেন।’
দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। তারা নিরাপত্তাবাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। বিবিসিকে এমনটাই বলছিলেন, রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন। তিনি বলেন, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে জলদস্যুতা বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে। কিন্তু সমপ্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে সেইদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে। সামরিক দিক থেকে দেখলে, (হুথিদের) ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের আক্রমণ মোকাবেলা করাটা বেশি জরুরি। তাই, ড্রোন–ক্ষেপণাস্ত্র সামাল দিতে গিয়ে জলদস্যুদের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না তারা।
একই ধারণা পোষণ করে ইন্ডিয়ান ওশান কমিশন (আইওসি)। গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে আইওসি হাইজ্যাকিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণও উল্লেখ করেছে। দেড় দশক আগে প্রথম দফায় জেলেরা যে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম কারণ, বিদেশি ট্রলার এসে তাদের এলাকায় অবৈধভাবে মাছ ধরতো। ফলে, স্থানীয় জেলেরা জীবিকার সংকটে পড়ে ডাকাতিকে পেশা নিতে বাধ্য হয়। বর্তমান সোমালি মৎস্য নীতির কারণে আবারও বিদেশি মাছ ধরার জাহাজের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে আবার উপকূলীয় সোমালিরা জলদস্যুতার পথে পা বাড়াবে এমন সতর্কতা জানায় সংস্থাটি। সোমালিয়া–ভিত্তিক আল–শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠী ডাকাতিতে উস্কানি দিচ্ছে এমন প্রসঙ্গও উঠে আসে আইওসি’র বিবৃতিতে। একটি কথিত সমঝোতা ব্যাপারে শোনা যায়। যার বদৌলতে জঙ্গিরা দস্যুদের সুরক্ষা দেয়। বিনিময়ে আদায়কৃত মুক্তিপণের একটি ভাগ পায় তারা।
ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলকে হর্ন অফ আফ্রিকা বলা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।
জাহাজের মালিকদের লুকআউট বা দ্রুতগতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি। যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে। কিন্তু, জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়শই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই, ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতেই দেরি হয়ে যায়।