কোনো শিল্পী হঠাৎ যখন করুণ সুরে গেয়ে উঠেন, ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ’ আবার আর এক বিখ্যাত শিল্পী যখন বলেন, ‘ও চাঁদ, সামলে রেখো জোছনাকে’– এরকম আরো অনেক কবিতা আর গান যখন মনে সুরের মায়াজাল ছড়ায় তখন চাঁদের সৌন্দর্য আর অপার রহস্য আমাদের কাছে কেবল রহস্যময় হয়ে ওঠে। সুনীল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো মানবমনে অজানা এক শিহরণ ছড়ায়। যদি এমনটি হয়, মাথার উপরে বিশাল আকাশের চাঁদোয়া। সেই আকাশে সন্ধ্যাতারার উন্মেষকালে হাজার নক্ষত্র জ্বলছে মিটিমিট করে। তখনো ধরাতলে অন্ধকার। হঠাৎ ভরা পূর্ণিমার রূপালী চাঁদটি যদি তার যাবতীয় রূপসুধা ঢেলে দিতে মর্ত্যে নেমে আসে আকাশপরী হয়ে। অবিরাম মায়াবী জোছনার অমৃতসুধা ঢেলে সে ধুলিমাটির পৃথিবীকে অপার্থিব এক সুন্দরে পরিণত করে। চন্দ্রালোকের সে কি মায়া! যেনো অপূর্ব এক অপ্সরী, অনাবিল রূপমাধুরীর মোহ আর মরিচীকার বন্ধনে পৃথিবীর মানুষগুলোর অন্তরে সে জোছনার প্লাবন বইয়ে দেয়। এই সুন্দর নয়নভরে দেখা যায়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, কিন্ত ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, স্পর্শও করা যায় না।
আসলে পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের আধার এই চাঁদের সাথে আমার প্রথম মিতালী। আমার মায়ের মুখে ছড়া শুনে ‘আয়, আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো, মাছ কুটলে মুড়ো দেবো, কালো গাভীর দুধ দেবো দুয়ারে বসে খা ’ । আবার আর একটু বড় হলে যখন জিজ্ঞেস করতাম চাঁদে কি আছে ? আমার নানীজান বলতেন, চাঁদে এক বুড়ি আছে, তার কাজ চরকায় বসে সূতা কাটা। কি বিশ্বাস করেছিলাম চাঁদের দিকে তাকিয়ে। আসলেই তো। এক বুড়ি চাঁদে বসে সূতা কাটছে। হয়তো এই সূতা দিয়ে আমরা রূপালী জরির ফিতা পরবো চুলে। জরির পোশাক পরে ডানাকাটা পরী সেজে উড়াল দেবো চাঁদের দেশে। আর দিন যাচ্ছে। কালে কালে আমরা একটু একটু করে রড় হচ্ছি , চাঁদ কিন্তু ঠিক একই জায়গায় স্থির। বরঞ্চ তার এই অপার সৌন্দর্য আর অমিয় সুধারাশিতে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য আর শিল্পের ভাণ্ডার। গান , ছড়া , কবিতা , গল্প আর উপন্যাসে চাঁদ পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উপমা আর অভিধা।
আমার কিশোরীবেলায় গ্রামের বাড়িতে চাঁদের অমিয় রূপসুধা দেখেছি , তা আমার জীবনের সেরা চাঁদ হিসাবে মিশে রয়েছে শিরা উপশিরায়। দিবারাত্রির সন্ধিক্ষণে গ্রামটাকে ছবির মতো সুন্দর লাগতো। পশ্চিমাকাশে সূর্যের লাল আভা আকাশটাকে রাঙিয়ে দিতো তখনো ভ্যানগগ, লিওনার্দোদের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। এরপর ও মনে হতো কোন এক শিল্পীর রাঙা তুলির আঁচড়ে আকাশে দিনের সমাপ্তিটা অদ্ভুদ এক সুন্দরে পরিণত হয়েছে । সন্ধ্যার পরে পাড়া গাঁয়ের বাড়ি ঘর যখন নিঃসীম নিরালায় ডুবে যেতো, তখন এই আলো–আঁধারির রহস্য ভেদ করে সুনির্মল আকাশে এক ফালি রূপালী চাঁদ তার অপূর্ব রোশনাই ছড়িয়ে আমার কোমল মনটাকে চনমনে করে তুলতো। আমদের ঘরের উঠোনে ছিল ইয়া লম্বা এবটি কাউফলের গাছ। চাঁদের আলোাতে এই গাছের পাতাগুলো চিকচিক করতো। আার আদুরবাদুর চালতা বাদুর কলা বাদুর মিলে এই গাছে ঝুলতো,আর ডানা ঝাপটাতো। আরো আসতো লক্ষ্মী পেঁচা, হুতোম পেঁচা, অলক্ষুণে কুইক্যা পাখি। এসবের মাঝে কিছুটা ভয় আর চাঁদের অমিয় সুন্দর আমায় নিয়ে যেতো কোনো এক কল্পজগতে। যে জগত আমার চেতনায় রূপকথার গল্প শোনাতে শোনাতে গেঁথে দিয়েছিলেন আমার নানীজান। তাই ছোট হলেও চাঁদের পানে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকতাম। চোখে ভাসতো চাঁদনী রাতে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কথোপকথন। রূপকথার রাজকুমার ঢাল তলোয়ার নিয়ে এই বুঝি আসছে ঘোড়া ছুটিয়ে। এদিকে রাতজুড়ে জোছনার প্লাবন। আর আামি খুঁজতাম পরীর দলকে, যারা যেদিন খুকুমনি জন্ম নিয়েছিল, তাকে জোছনামাখা রাতে ঘুম পাড়াতে এসেছিল। আবার ভয়ও হতো । চাঁদের আবছা আলোতে পকুরপাড়ের বাঁশঝাড়ের নীচে মনে হতো সাদা পোশাক পরা ইয়া লম্বা একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে , তখন গা ছমছম করে উঠতো। বাঁশবনে বেতঝাড়ে জোনাকিরা মিটিমিটি করে জ্বলতো আর নিভতো। ওদের ধরতে চাইতাম কিন্তু ওই যে সাদা পোশাকের মানুষটির ভয়ে আধমরা হয়ে যেতাম। তবে কর্ষাকালে বানের জল কমতে শুরু করলে বিলভরা জলে চাঁদের আলোতে নৌবিহারে চন্দ্রকলার সাথে নবপরিচয়ের আরেক সোপান আমার। ষোড়শ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর লিখেছিলেন: ‘কে বলে শারদ শশী আকাশের গায়/ তব নখে শত শশী গড়াগড়ি যায় ’। আসলেই জোছনা রাতে সবার বনে যাওয়ার মতোই ছিল প্রতি বর্ষার নৌবিহারটি। ঘনঘোর বরিষন শেষে যখন বানের জল অল্প অল্প নামতে শুরু করতো, তখন রাতে চাঁদের আলোতে নৌকাভ্রমণে অন্যরকম এক মিতালী হতো জোছনার সাথে। তবে মুরুব্বীদের অগোচরে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা এই বিহারের যাত্রী হতেন। আমাদের ছোট বলে খেলায় যেমন নিতো না, এই বিহারেও বাদ দেয়ার প্ল্যান করতেন। কিন্তু আমি আর আমার দুই খালা পারভীন আর নাসরীন (নাসরীন এখন প্রয়াত) কেঁদে কেটে ঝগড়াঝাটি করে নৌকায় উঠে যেতাম। বিলভরা বানের জল, পুকুর ডোবা খাল বিল জলে টইটুম্বুর। আকাশ থেকে গলে গলে জোছনা পড়ছে মোমের আলোর মতো। আর আমাদের বিশাল তরণীকে মাঝি তার বৈঠা দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ ছন্দে এড়িয়ে নিচ্ছে। নৌকায় কারা কারা থাকতেন সঠিক মনে পড়ছে না। তবে আমার মামারা, খালারা , আপারা থাকতেন। সৈয়দ মামু ডাকতাম একজন কেয়ারটেকারকে । উনিও থাকতেন পাহারাদার হিসাবে। রাতের গ্রাম নিস্তব্ধ, নির্জন। যে দিকে তাকাই শুধু জল আর জল। জলের সাথে জোছনার খেলা, জলতরঙ্গ আর জোছনার বন্যায় সারা গ্রাম প্লাবিত। বিল থেকে প্রান্তর পেরিয়ে নৌকা যখন খালে প্রবেশ করে , তখন মাঝি ‘বদর বদর ’ বলে চিৎকার করে যাত্রীদের সতর্ক করতেন। কারণ খালে তীব্র স্রোত, হঠাৎ নৌকা উল্টে গিয়ে বিপদ হতে পারে। প্রকৃতিতে পূর্ণিমার জোয়ার, খালে জলের জোয়ার আর নৌকায় আমাদের আনন্দের জোয়ার। প্রায় ঘণ্টা দুই তিনেকের এই ভ্রমণে চাঁদের সাথে, জোছনার সাথে অন্যরকম এক মিতালী গড়ে উঠতো আমাদের। চাঁদ এখন সে জায়গায় থেমে নেই। মানুষ চন্দ্রাভিযানে গিয়ে চাঁদের বুকে পৃথিবীর পতাকা উড়িয়ে চন্দ্রকে বিজয় করেছে। গবেষণা থেমে নেই চলছে, চলবে। কিন্তু চাঁদের অপার সৌন্দর্যরশ্মি মানুষের মনপ্রাণকে উজ্জীবিত করবেই। মানুষ চাঁদের আলোকে প্রাণখুলে উপভোগ করবে। কল্পনায় ভাসবে, হয়ে উঠবে সৃষ্টিশীল। নিজেরা সমৃদ্ধ হবে, আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে আলোকিত করবে চাঁদের আলোর মতোই।
খ্যাতিমান লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা চন্দ্রাহত হয়েছিলেন। তিনি কোনো এক দোল পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোকে গায়ে মাখার উদ্দেশ্যে পুকুরের স্বচ্ছ টলটলে জলের ধারে বসেই রাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বকবি বলেছিলেন, ‘রাত কাটে, ভোর হয় পাখি জাগে বনে/চাঁদের তরণী ঠেকে ধরণীর কোণে’ । আর কবি নজরুল বলেছেন, ‘চাঁদ হেরিছে , চাঁদ মুখ তার সরসীর আরশিতে’ । অন্যদিকে নন্দিত লেখক হুমাযূন আহমেদ বলেন, ‘ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই/ হাত ভর্তি চাঁদের আলো ধরতে গেলে নাই।’ রহস্যাবৃত চাঁদ আর তার গলে পড়া জোছনা আমাদের কাছে অপার সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে থাকুক । যতোদিন পৃথিবী থাকবে, ততোদিন চাঁদ নামের এই গ্রহটি তাঁর অপূর্ব জোছনার আলো দিয়ে গৃথিবীর মানুষগুলোকে আলোকিত করুক।