‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে
ও সে–তো মুখ খুলেনি
সুর শুধু সুর তুলেছে
ভাষা তো দেয়নি’…
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ভুবনে একটি অতি জনপ্রিয় গান। আজ ৪৫ বছর ধরে সমান জনপ্রিয়। আজও একই আবেগে ও আবেদনে গানটি গেয়ে চলেছেন শিল্পীরা। গানটির গীতিকার নকীব খান। সুরকার জিলু খান। কিভাবে সৃষ্টি হলো এই জনপ্রিয় গান– জানতে চাইলাম নকীব ভাইয়ের কাছে। তিনি জানালেন: “১৯৭৮ সাল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। বড় ভাই জিলু খান একদিন একটি সুর গুনগুন করছিলেন। শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। আমি শুনে ঐ সুরে প্রথম চার লাইন লিখি। পরে বড় ভাইকে দেখালাম। উনি তা দেখে খুবই খুশী হলেন। বললেন: খুব সুন্দর হয়েছে। এসো, আজই গানটি শেষ করে ফেলি। এভাবে সেইদিনই গানটি তৈরি হয়ে গেলো।” পরে সোলস ব্যান্ডের মূল গায়ক তপন চৌধুরী গানটি গাইলেন। বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড ক্যাসেট ‘সুপার সোলস’–এ রিলিজের পর তুমুল জনপ্রিয় হয়। সেই জনপ্রিয়তা আজ বজায় আছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে এ–এক বিস্ময়কর।
গানে ও সুরের আবহে বেড়ে উঠা…
নকীব খানের বাবা মরহুম আইয়ুব খান। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিজে একজন সংগীতপ্রেমী মানুষ। শখে গান গাইতেন তিনি। তাই নকীব খান পারিবারিক আবহে গানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন শৈশব থেকেই। তাঁর নানা কবীর খান সিদ্দিকী ছিলেন কাওয়ালী গায়ক। কোলকাতা থেকে এলপি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই পরিবারের তিন সন্তান জিলু খান, নকীব খান, পিলু খান– সংগীত শিল্পী হয়ে নিজেদের গড়ে তোলার পরিবেশ পেয়ে যান। তারই সূত্র ধরে জিলু খানই প্রথম গড়লেন একটি ব্যান্ড– বালার্ক। স্বাধীনতা উত্তরকালে চট্টগ্রামে বালার্ক দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। প্রবাল চৌধুরী, উমা ইসলাম প্রমুখ শিল্পীরা গান গাইতেন। সুর করতেন জিলু খান। এভাবেই স্কুল পড়াকালীন সময় থেকেই নকীব খান গান গাওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে উঠলেন। একোডিয়ান বাজানো শিখলেন নকীব খান এবং বালার্ক ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। এভাবেই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই নকীব খানের সংগীত জীবন শুরু। সালটা তখন ১৯৭৩।
সোলস
বড় ভাই জিলু খান ঢাকাবাসী হলেন। বালার্ক আর বন্ধ হয়ে গেল। পরে নকীব খান যোগ দিলেন সোলস–এ। দীর্ঘ দশ বছর সোলস–এর সাথে যুক্ত থেকে অনন্য গৌরবময় সংগীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। নকীব খান সোলস ব্যান্ডে যুক্ত হওয়ার পর সোলস মৌলিক গান গাইতে শুরু করে। নকীব খানের সুরে সোলস নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সোলস এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে। সেরা কীবোর্ড বাদক হন নকীব খান। এবং তাঁর সুরে গান সেরা গান হিসেবে পুরস্কৃত হয়। “সুপার সোলস” ক্যাসেট রিলিজের পর সোলস–এর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। পরবর্তীতে ব্যান্ড মিউজিকে একজন সুরকার, কীবোর্ড বাদক এবং গায়ক হিসেবে নকীব খান খ্যাতি অর্জন করেন। ঐ সময়ে তাঁর সুর করা আরেকটি গান আজও সমান জনপ্রিয়। গানটি হলো আবদুল্লাহ আল মামুনের লেখায় “এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে।”
সৈকতচারী…
১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে কয়্যার ভিত্তিক সংগীত দল ু “সৈকতচার।” দশজন পুরুষ ও দশজন মহিলা শিল্পী নিয়ে গড়া এই “সৈকতচারী” গানের দলটি ব্যাপক সাড়া জাগায়। সোলস–এর সদস্যরা এই দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। মহিলা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কাকলী দেওয়ান, রুমী বড়ুয়া, কেরিন সাত্তার, মিতা চৌধুরী, আল্পনা চৌধুরী, সোহানা সিদ্দিকী, রুমানা, রোখসানা সাফা, হাসিনা আহমেদ সোমাসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী। ১৯৮০ সালে “সৈকতচারী” দলটি ওস্তাদ কিরীট খানের আমন্ত্রণে কোলকাতা গিয়েছিল। এবং বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত নায়িকা সুচিত্রা সেনের বাসায় গিয়ে তাঁকে গান শুনিয়ে এসেছে। এই বিষয়ে নকীব খান স্মৃতিচারণে বলেন, “সুচিত্রা সেনকে আমরা গান শোনাতে পেরেছি এটা আমাদের জন্য পরম পাওয়া। তবে তিনি আমাদের সামনে আসেননি। তিনি আলাদা কক্ষে ছিলেন। পাশের কক্ষে আমরা গান পরিবেশন করি। উনার বাসায় যাওয়ার সময় শর্ত ছিল, কোন ক্যামেরা নেয়া যাবে না। তাই আমাদের আর ছবি তোলা হয়নি।”
রেনেসাঁ…
নকীব খান ঢাকাবাসী হলেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ এবং চাকুরি সূত্রে। সোলস ছেড়ে দিতে হলো। বেশ কিছুদিন ঢাকায় চলচ্চিত্র সংগীত জগতে কিবোর্ড বাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরিতে যোগ দেন। পরে ছোট ভাই পিলু খানসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে গড়লেন ব্যান্ড “রেনেসা”। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে “রেনেসাঁ” এক উজ্জ্বল নাম। এই দলের বেশ কয়েকটি ক্যাসেট রিলিজ হয়েছে এবং গানও তুমুল জনপ্রিয় হয়।
ব্যান্ড সংগীতের ভুবনে নকীব খানের নামটি আজ ব্র্যান্ড। নকীব খানের গান মানেই অসম্ভব সুন্দর মেলোডিয়াস গান। মুজিব শতবর্ষে নকীব খানের সুরে এবং কামাল চৌধুরীর কথায় গান “তুমি বাংলার ধ্রুবতারা” বেশ প্রশংসিত হয়। এছাড়া শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা ও নকীব খানের সুরে “শোনো হে ছোট ছোট বন্ধুরা” গানটি নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরেছে। এই গানটিও প্রশংসিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান নিয়েও কাজ করেছেন নকীব খান। তাঁর সুরে শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা “আঁরো দেশত যাইয়ু তুঁই” এবং আসিফ ইকবালের লেখা “হতদিন হইয়ে দে বাড়িত ন যাইদ্দে” গান দুটো শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। চিত্রশিল্পী খালিদ আহসানের লেখা এবং নকীব খানের সুরে “নদী এসে পথ সাগরে মিশে যেতে চায়”, “ঘুম নেই ঘুম হারা চোখের কোণে ঘুম নেই”, “রেলগাড়ি চলে ঐ ঝিকঝিক”, “রাতের কবিতা তোমরা শোনো”, “রানওয়ের মাটি ছুঁয়ে” জনপ্রিয় গানগুলোর অন্যতম।
২০২৩ সাল নকীব ভাইয়ের সংগীত জীবনের ৫০ বছর। বিশাল অর্জন। বিশাল ভক্তকুল আছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: আমরা কী কিছু করবো এই ৫০ বছর উপলক্ষে? নকীব ভাই বললেন, এবছর নয়। আগামী বছর। ২০২৪ সালে। তাঁর নিজের কিছু পরিকল্পনা আছে। সুতরাং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
সংগীত জীবনের ৫০ বছর পূর্তিতে গায়ক, সুরকার, গীতিকার, বাদ্যযন্ত্র শিল্পী, সংগীত পরিচালক নকীব খানকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।