সুধাময়ী সংগ্রাম ও সাফল্যের নাম

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ৪ মে, ২০২৪ at ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ

টিকিট প্লিজ”বলে টিটি আমার কাছে এসে দাঁড়াতে আমি একটু অবাকই হলাম। বললাম– “এইমাত্র টিকিট দেখালাম যে!” টিটি বলল– “আপনার নয়, আপনার সিটের নিচে আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছি যে।”

বেরিয়ে এসো”বলতেই দেখি একটা বছর তেরোচোদ্দর মেয়ে অস্বাভাবিক কান্নাকাটি করছে। টিকিট তো নেইই। তার ওপর শীর্ণ, অভুক্ত, মলিন একটা মুখ। টিটি বলল– “ভাগো ইঁহা সে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম– “কোথায় নামবে তুমি?”

কোনো উত্তর নেই, শুধু কান্নাকাটি। বাধ্য হয়ে টিটিকে বললাম– “ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি, একদম শেষ স্টেশন ব্যাঙ্গালোর অবধি টিকিট দিন।” টিটি বলল– “কেন ফালতু এতগুলো টাকা নষ্ট করবেন ম্যাডাম?” তবুও কি ভেবে বললাম– “না, আপনি টিকিটই দিয়ে দিন। শুধুই কাঁদছে। শেষ অবধি কাটা থাকুক। মধ্যিখানে কোথাও নেমে যাবে হয়তো।”

আমায় অবাক করে মেয়েটি কোথাও নামল না। নাম জানলাম চিত্রা। নিজের বাবা মা কেউই নেই দুনিয়ায়। সৎ মা খুব খাটায় এবং মারে। সে তাও সহ্য করে নিয়েছিল, কিন্তু খেতে দিত না যে। খিদের জ্বালায় পালিয়ে এসেছে। শুধু এটুকু ভেবেছে যে, ওই নরকের চেয়ে অন্তত ভালো থাকবে।

ব্যাঙ্গালোরে নামলাম। শুধু একবার পিছন ঘুরেছি, দেখি চিত্রা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। টিকিট কাটার সময় একবারও ভাবিনি এই মেয়েটার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। আমার পক্ষে এগুরু দায়িত্ব নেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়, আমার ট্যুরে যাওয়া আছে দুদিন বাদেই। তবুও বললাম-“এসো আমার গাড়িতে এসো।” ড্রাইভার অবাক হয়ে বারবার দেখছে।

আমার এক বন্ধু আছে রাম। সে মেয়েদের শেল্টার দেয় ও আরো সমাজসেবামূলক কাজ করে। ওর ওখানে চিত্রাকে দিই। আর বলি, আমাদের ইনফোসিস ফাউন্ডেশন ওর সমস্ত দায়িত্ব নেবে। থাকতে চাইলে থাকবে, নয়তো আবার পালাবে মেয়েটা।

ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। হঠাৎ মনে পড়তে দেখতে গেলাম। কি হাসিখুশি হয়েছে এখন চিত্রা আর পড়াশোনায় ভারী আগ্রহ। ও স্কুলে আবার ভর্তি হতে চায়। এভাবে চলতে লাগল।

ওকে একদিন গিয়ে বলেও এলাম, তুমি যতদূর পড়তে চাও পড়তে পারো। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি।

আমায় অবাক করে বলল, “না আঁকা (দিদি), আমি তাড়াতাড়ি একটা চাকরি পেতে চাই। তাই কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা করব।”

তারপর প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। হঠাৎ একদিন বিদেশ থেকে ইমেল পেলাম চিত্রার। ও বিদেশে চাকরিতে খুব উন্নতি করেছে আর এখন খুব হাসিখুশি সুন্দর জীবন ওর। মেল পড়ে ভগবানকে বললাম, ওর মুখের হাসি যেন এমনই থাকে।

এবারে সান্সফ্রান্সিসকোতে একটা লেকচার দিতে গিয়েছি। যখন হোটেল থেকে চেক আউট করব, গিয়ে দেখি রিসেপশনিস্ট বলছে, “ম্যাম, আপনার সমস্ত বিল ফুললি পেড। ওই লেডি নিশ্চয়ই আপনাকে খুব ভালো করে চেনে।”

খুব অবাক হয়ে চারিদিকে দেখলাম, দেখি একজন ভদ্রমহিলা সুন্দর একটা শাড়ি পরা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। পাশে ফরেনার বর। কি সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে ছোট ছোট চুলে। সেই চিত্রা। এসে আমায় জড়িয়ে ধরল।

চিত্রা তুমি আমার সমস্ত বিল কেন পে করবে?”

আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল– “কারণ তুমি একদিন আমার সমস্ত বিল পে করেছিলে। আমার সমস্ত জীবনটাই যে ওই পেমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই বম্বে টু ব্যাঙ্গালোর।”

এই ঘটনা ইনফোসিসের কোফাউন্ডার সুধা মুর্তি তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন। এই কথার মাধ্যমে সুধা মুর্তি বোঝাতে চেয়েছেন, কীভাবে কোমলতা ও উদারতা দিয়ে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিবর্তন করা সম্ভব। এই ঘটনা থেকেই তাঁকে চেনা। শুরু করলাম জানা, গুগোল ঘেঁটে।

সুধা মুর্তি বিবাহের পূর্বে সুধা কুলকার্নি। একজন ভারতীয় প্রকৌশল শিক্ষক এবং কন্নড় ও ইংরেজিতে ভারতীয় বিখ্যাত লেখক। জন্ম ১৯ আগস্ট ১৯৫০ (বয়স ৭৩) শিগাঁও, কর্ণাটক, ভারত। ১৯৯৫ সালে ব্যাঙ্গালোরের রোটারি ক্লাব থেকে তিনি “সেরা শিক্ষক পুরস্কার” পান। মুর্তি তাঁর সামাজিক কাজ এবং কন্নড় ও ইংরেজিতে সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।

পুরষ্কারেও ভূষিত হন পদ্মশ্রী (২০০৬), দানা চিন্তামণি আত্তিমব্বে (২০১০), পদ্মভূষণ (২০২৩)

সুধাদেবীর বাবা ছিলেন ডাক্তার, নামী সার্জন। সুধা ইঞ্জিনিয়ারিংই বেছে নেন। পরিবার থেকে বাধা এসেছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়বার। অনড় থেকেছেন তিনি। এবং পড়েছিলেনও।

ক্লাসে ৫৯৯ টা ছেলে আর একটিই মেয়ে। সে আমলে মেয়েরা তেমন কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত না। সুধা জোর করে ভর্তি হয়েছিলেন, কর্ণাটকের হুবলির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। তিনি সেশহরের প্রথম ছাত্রী। কলেজের প্রিন্সিপাল সুধাকে ডেকে বলেছিলেন, তিনটি শর্ত মানতে হবে। শাড়ি পরে আসতে হবে। কলেজ ক্যান্টিনে ছেলেদের ভিড়, ওদিকে যাওয়া চলবে না। কোনো ছেলের সঙ্গে ক্লাসে কথা বলা যাবে না।

তিনি তিনটিই মেনে চলতেন। কিন্তু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে তিন নম্বর শর্তটি আর মানা সম্ভব হয়নি। ছেলেরা তাঁর কাছে এসে কথা বলল। কারণ ওই ৬০০ স্টুডেন্টের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিলেন সুধা। তিনি তারপরে আর কোথাও দ্বিতীয় হননি। গোল্ড মেডালিস্ট। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে সেই মেডেল নেন।

কিন্তু পাস করে বেরোনোর পর তাঁর জন্য কোথাও কোনো চাকরির দরজা খুলল না। সমস্ত কোম্পানিই মেল ডমিনেটিং। মহিলা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য দরজা বন্ধ। কি আশ্চর্য! খুব বেশিদিন আগের কথাও না। ১৯৭০/৭২এর ঘটনা ।

এইসময় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে সুধা কুলকার্নির। ইঞ্জিনিয়ার চাই। যোগ্যতা অমুকতমুক। কিন্তু নিচে বড় হরফে লেখা মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই। টেলকো কোম্পানির বিজ্ঞাপন ছিলো সেটা।

তিনি খুব রেগে গেলেন আর টাটা কোম্পানিতে স্বয়ং জে আর ডি টাটাকে একটা চিঠি লিখলেন। এরকম কেন হবে? যোগ্যতাই কি একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না? টাটা কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। ডাক পেলেন স্পেশাল ইন্টারভিউতে এবং বাকিটা তো ইতিহাসই। তিনিই টাটার টেলকো কোম্পানির প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার। ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে যোগ দিলেন। কাউকে না কাউকে তো এই লড়াইটুকু চালাতে হয় এবং তার সুফল ভোগ করতে পারে পরবর্তী প্রজন্ম। এরপর ওই টেলকোতেই নারায়ণ মূর্তির সঙ্গে আলাপ। তারপর বিয়ে।

নতুন কিছু করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি না নিতে পারলেই উন্নতি করা যায় না। তবে কীভাবে এত বড় উদ্যোগের জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন সুধা মুর্তি, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। ইনফোসিস খোলার কথা মাথায় আসে কিন্তু নারায়ণের।

কারণ, অনেকেই ইনফোসিস কোম্পানির নাম শুনলেও, এই কোম্পানি তৈরির নেপথ্যে যার সঞ্চয় প্রথম বিনিয়োগ হিসেবে এসেছিল নারায়ণ মূর্তির হাতে, তিনি হলেন তাঁরই অর্ধাঙ্গিনী সুধা মুর্তি। তাঁদের দুজনের ভালোবাসার গল্পটা একটু অন্যরকম।

মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছেন সুধা মুর্তি। এন আর নারায়ানা মুর্তি যখন সুধাকে বিয়ে করেন, তখন তিনি বেকার। তবে স্বামীর ওপর ভরসা ছিল সুধার। তাই যখন নারায়ানা মুর্তি সুধাকে বললেন যে, তিনি একটি আইটি কোম্পানি খুলতে চান, তখন সুধা তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদায় আঘাত করেন নি।

তাই হয়তো তিনি নিজের সব সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছিলেন স্বামীর পরিকল্পনায়। সুধা একটি ছোট্ট টিনের বাক্সে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন, যার মোট পরিমাণ ছিল দশ হাজার দুশো পঞ্চাশ টাকা। এর মধ্যে দুশো পঞ্চাশ টাকা এমার্জেন্সির জন্য রেখে, বাকি দশ হাজার টাকা স্বামীকে দিয়েছিলেন ধার হিসেবে।

আর তাতেই ইনফোসিসএর যাত্রা শুরু হয়। ইনফোসিসএর যখন স্বর্ণযুগ চলছে, তখন নারায়ানা মুর্তি স্ত্রীকে এক কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখন নিজে সেটি না নিয়ে মাদার টেরিজাকে পাঠিয়ে দিতে বলেন। সমাজসেবায় সেই টাকা নিয়োজিত হয়।

তারপর দেশের নানা প্রান্তে ৭০০০০ লাইব্রেরি, ১০০০০ টয়লেট, ২৬০০ গৃহহীনকে গৃহ, দেশের খরা, বন্যা সবেতে নীরবে কাজ করে চলে ইনফোসিস।

তিনি একদিকে শিক্ষিকা, লেখিকা, আবার অত বড় কোম্পানির চেয়ারপার্সন। বহু সম্মান, বহু পুরস্কার তাঁর ঝুড়িতে ভরেছে।

একদিকে সুধা ভারতবর্ষের সবথেকে বড় আইটি কোম্পানি ইনফোসিসএর মালিকের স্ত্রী, অন্যদিকে তাঁর জামাই ঋষি সুনক এখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। তবে তা সত্ত্বেও নিজেকে আভিজাত্যের মোড়কে মুড়ে ফেলেননি সুধা।

তিনি এক টিভি শোতে বলেছিলেন, লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসার বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে তার ঠিকানা হচ্ছে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। সেই ইমিগ্রেশন অফিসার নাকি মনে করেছিল, তিনি রসিকতা করছেন। সুধা বলেছিলেন, তার সাদামাটা বেশভূষার জন্যই হয়তো ঐ কর্মকর্তা এমনটি ভেবেছিলো।

টাটা কোম্পানি ছাড়ার সময়ে JRD TATA তাঁকে অমূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন, “সবসময় একটা কথা মনে রাখবে, তোমার সমস্ত টাকা পয়সার তুমি অছিমাত্র (ট্রাস্টি)। টাকার সবসময় হাতবদল হয়। হাতে রেখে লাভ নেই। টাকা বড় ক্ষণস্থায়ী। যদি সাফল্য আসে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেবে। সেটাই কিন্তু চিরস্থায়ী।

তিনি আজও ভোলেননি সেকথা এবং সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি বলেন– “বিগত একুশ বছর আমি কোনো শাড়ি কিনিনি। যা পরি সবই পাওয়া, আমি শুধু বই কিনি।”

তাই কম দামী শাড়ী পরা, সাধারণ কথাবার্তা বলা, মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করা, ঠাঁটবাটহীন জীবনযাপন তিনি পছন্দ করেন। এখনো তিনি আগের মতোই কলেজে পড়ান।

এছাড়াও, আগের মতোই পায়ে হেঁটে বা ফিয়াট ট্যাক্সি চেপে ঘুরে বেড়ান। কারণ, এলিটক্লাসের জন্য নয়, নিজেকে তিনি সঁপে দিয়েছেন মানুষের জন্য। মহিয়সী মহিলারা তো এমনই হন!

একবার এমনও হয়েছিল তিনি প্লেনের বিজনেস ক্লাস লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এক ভদ্রলোক তাঁর সাজপোশাক দেখে তাঁকে “Cattle Class” বলেছিলেন! তিনি জানতেন না সুধা মুর্তি ভারতের Richest Person দের মধ্যে অন্যতম। পদ্মশ্রী সুধা মুর্তি বলেন– “Simplicity is the best jewellery I wear.”

পূর্ববর্তী নিবন্ধউত্তরাধিকার আইন ও নারীর অধিকার
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে আগুনে পুড়েছে ৩ দোকান ও বসতঘর