সারি সারি পোড়া দেহ

সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ আগুন ।। মৃতের সংখ্যা ৫২ ।। আছে শিশু শ্রমিকও ।। ভেতরে প্রচুর দাহ্য ভোজ্যতেল ।। ছিল না অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ ঘণ্টা পর কারখানার ভেতর থেকে এক এক করে ৪৯টি পোড়া মরদেহ বের করে আনা হয়েছে। মরদেহগুলো ফায়ার সার্ভিসের চারটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে এ ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫২ জন। এছাড়া আহত হন আরও অন্তত ৫০ জন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে ৪৯টি পোড়া মরদেহ ফায়ার সার্ভিসের চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডেমরা, কাঞ্চনসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগুন লাগার পর অনেকেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে গুরুত্বর আহত হন। তাদের স্থানীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেলসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল ভোরের দিকে, আবারো বেড়ে যায়। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের।
শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুস কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ করে। সাত তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করে। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন।
আব্দুল আল আরেফিন জানান, কারখানা পুরোটাই পুড়ে গেছে। আগুনের সূত্রপাত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
পোড়া লাশগুলো দেখে চেনার উপায় নেই : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত অধিকাংশের দেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে, চোখে দেখে তাদের আর চেনার উপায় নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা জানিয়েছেন, নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মৃতদেহগুলোর নমুনা সংরক্ষণ করা হবে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, মৃতদেহগুলো পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পরিচয় সনাক্ত করা অসম্ভব। তাই আমরা ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রকৃত স্বজনদের হাতে মৃতদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। যতদিন লাগে মৃতদেহগুলো মর্গেই থাকবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত স্বজনদের কাছে মৃতদেহগুলো বুঝিয়ে দিতে।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বলেন, মৃতদেহগুলোর সুরতহাল করবে জেলা পুলিশ এবং তারপর ময়নাতদন্ত হবে। সার্বিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য মহানগর পুলিশ মর্গে রয়েছে।
এদিকে মর্গে একের পর এক সাজিয়ে রাখা মৃতদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করতে বিকালেই কাজ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। বিকাল ৫টার দিকে সিআইডির কর্মীরা ছবি তুলে নম্বর বসানোর প্রাথমিক কাজ শুরু করেন।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর মনির বলেন, চিকিৎসক ওই নম্বর ধরে মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের দেবেন। আমরা সিআইডির ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা করব।
পরিচয় নিশ্চিত করতে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের নমুনাও নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য মর্গের পাশে একটি কক্ষে জড়ো হওয়া স্বজনদের কাছ থেকে নাম ঠিকানা সংগ্রহ করতে দেখা যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশকে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
লাশ বুঝে পেতেও তিন সপ্তাহের অপেক্ষা : নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের লাশ শনাক্ত করে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে অন্তত তিন সপ্তাহ লাগতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষা করে মৃতদের শনাক্ত করার এই কাজটি করবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। ইতোমধ্যে তারা কাজও শুরু করে দিয়েছে।
সিআইডির বিশেষ সুপার (ফরেনসিক) রোমানা আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিটা মৃতদেহ থেকে দাঁত ও হাড় সংগ্রহ করব। দাঁত ও হাড়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে অন্তত ২১ দিন সময় লাগবে। শনাক্ত হওয়ার পর পুলিশ মৃতদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে বলে জানান তিনি।
ভেতরে প্রচুর দাহ্য ভোজ্যতেল : আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানার ভেতরে প্রচুর ভোজ্যতেল পাওয়া গেছে, যার কারণে আগুন বেশি সময় ধরে জ্বলেছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে কারখানায় আগুন নেভানোর কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন ও পরিদর্শক ফখর উদ্দিন। ক্লান্ত দুজন বসেছিলেন কারখানার পেছনে একটা বেঞ্চে। মনির বলেন, চারতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একসঙ্গে অন্তত ২৫টি লাশ পাওয়া গেছে। ওই ফ্লোরে এক ধরনের নসিলা তৈরি হতো, যা তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হতো। ওই ভোজ্যতেলই মূলত জ্বালানি হিসেবে এতক্ষণ ধরে জ্বলছে। এছাড়া প্রচুর প্লাস্টিক ও কাগজের কার্টুন সেখানে ছিল।
ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না : হাসেম ফুডস কারখানার ভবনটিতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম যেমন ছিল না, তেমনি জরুরি বের হওয়ার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথও রাখা হয়নি বলে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গতকাল বিকালে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন্স লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, ভবনটির আয়তন প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট। ওই ভবনের জন্য অন্তত চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল। অথচ বড় এই ভবনে আমরা পেলাম মাত্র দুটি এঙিট। এর মধ্যে প্রথম এঙিট ছিল আগুনের মধ্যে। শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখানে কেউ যেতে পারেনি। দ্বিতীয় সিঁড়ির কাছেও তাপ ও ধোঁয়ার কারণে ভেতরে আটকে থাকারা যেতে পারেননি বলে তাদের ধারণার কথা জানান তিনি। যে কারণে সেই পথেও শ্রমিকরা বের হতে পারেননি।
বড় আকারের এই ভবনের ছয় ফ্লোর জুড়েই গোডাউন উল্লেখ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, টপ টু বটম কাঁচামাল জমা ছিল। ফ্লোরগুলোর কোনো অংশে ফাঁকা বা খালি স্থান রাখা হয়নি। এ কারণে পানি সব কর্নারে পোঁছাতে পারি না এবং এখনও ছোট ছোট আগুন ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। মূল আগুন রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে নেভানো হলেও প্রচুর সরঞ্জামের কারণে ছোট ছোট আগুন নেভানো যায়নি।
ছাদের সিঁড়ি বন্ধ না থাকলে অনেক প্রাণ বাঁচত : কারখানার একটি সিঁড়ি বন্ধ না থাকলে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন। তিনি ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গাড়ির মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা কিন্তু বাঁচাতে পারতাম।
সজীব গ্রুপের এই কারখানায় জুস, বেভারেজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। ছয় তলা ভবনের ছাদে ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছে, যার একটির ছাদের দরজা বন্ধ ছিল বলে জানান দেবাশিষ বর্ধন।
তিনি বলেন, চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালা বন্ধ ছিল। আর নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন। উনারা নিচের দিকেও আসতে পারেন নাই, তালাবন্ধ থাকায় উনারা ছাদেও যেতে পারেন নাই।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক সিদ্দিক মোহাম্মদ জুলফিকার রহমান বলেন, একেকটি ফ্লোর ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিটের। সিঁড়ি মাত্র দুটি। সিঁড়িতেও আগুন ছিল, ফলে অনেকে বের হতে পারেনি।
অগ্নিকাণ্ড প্রকাশ্যে আনল শিশুশ্রম : দুই তরুণীকে কাঁদতে কাঁদতে আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানার দিকে এগোতে দেখে তাদের পথ আটকায় পুলিশ। জানা যায়, তাদের কিশোরী বোন ওই কারখানায় কাজ করত, আগুন লাগার পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তিন বোনের মেজ ঝুমা জানালেন, তার নিখোঁজ বোনের নাম ইসরাত জাহান ফুলি, বয়স ১৬ বছর। বড় বোন লিমাকে নিয়ে তিনি কারখানায় এসেছেন ফুলিকে খুঁজতে।
তাদের মতো অনেকেই গতকাল সকাল থেকে সজীব গ্রুপের এই কারখানার ফটকে ভিড় করছিলেন ভেতরে আটকা পড়া প্রিয়জনের খোঁজে। রূপগঞ্জ থানার এসআই মিন্টু ফটকে বসে নিখোঁজদের তালিকা করছিলেন। ঝুমা ও লিমার কথায় তাদের বোন ফুলির নাম যুক্ত তিনি লিখে নিলেন সেই তালিকার ৪৮ নম্বরে। স্বজনদের কথায় জানা গেল, সেই তালিকার অনেকেরই বয়স ১৮ পার হয়নি।
১৪ বছর বয়সী ফারজানা গত তিন বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকায় এ কারখানায় কাজ করছিল বলে জানালেন তার মা ঝরনা বেগম। মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে তিনি কারখানা এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন।
তার সঙ্গে থাকা ফারজানার সহকর্মী ১৬ বছর বয়সী মৌমিতা জানালেন, হাসেম ফুডস কারখানায় সেজান জুস, চানাচুর, সেমাই, চকলেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। তবে বৃহস্পতিবার বিকালে যখন আগুন লাগে তিনি তখন কাজে ছিলেন না। তিনি জানান, তার বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরী ছিল কারখানার কর্মীদের মধ্যে। তবে কম বয়সীদের সাধারণত রাতের পালায় রাখা হতো না।
লিমা বললেন, পোশাক কারখানাগুলোতে কম বয়সীদের নেয় না। তবে হাসেম ফুডসে সেই সুযোগ ছিল বলে স্থানীয় অনেক কিশোর-কিশোরীই সেখানে কাজ করত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ১০ মৃত্যু শনাক্ত সর্বোচ্চ ৭৮৩
পরবর্তী নিবন্ধকঠোর বিধিনিষেধেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী