: একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউসুফ মিয়া বিস্মৃতির অতলে নির্বাসিত।
: হঠাৎ করে ইউসুফ মিয়া প্রসঙ্গ এলো কেন? জবাব হলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান এর নির্দেশনায় ১৯৮৮ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের অংশীদার হয়েছিলাম। ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম শহর চট্টগ্রামকে। তখন তথ্য সংগ্রহে প্রচণ্ড কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিলো। কাজ করতে গিয়ে গবেষণার দুয়ার খুলে গিয়েছিলো। তবে ছিলো প্রচুর সীমাবদ্ধতা। মানুষের আগ্রহের ঘাটতি দেখেছি। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। গ্রন্থগুলো হচ্ছে
১. নির্যাতন- ৭১।
২. রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক।
৩. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামের নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি।
৪. মধ্যম নাথপাড়া বধ্যভূমি।
৫. মুক্তিযুদ্ধে আমার কৈশোর।
প্রথম ৩টি গ্রন্থে নির্যাতিতা মা বোনদের ওপর ঘাতকদের নির্যাতনের তথ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অপারেশন, আশ্রয় কেন্দ্রের বিবরণ, মা-বোনদের সাহসী ও ত্যাগী ভূমিকা, তৃণমূলের বাঙালিদের জীবনবাজি রাখা ভূমিকা। হত্যাকাণ্ডের বিবরণসহ মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসের তথ্য। তথ্যের ভুলগুলো সংশোধন করে পুরো তথ্যের জন্য পুনরায় তৃণমূলে যেতে শুরু করেছি। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। অসংখ্য তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং আসতে শুরু করেছে। সবগুলো তথ্য দিয়ে গ্রন্থগুলো পুনরায় মুদ্রণের ইচ্ছা রয়েছে। আর সেজন্যই শহর চট্টগ্রামের প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় যাচ্ছি। সেই কাজের অংশীদার হয়ে গিয়েছিলাম আগ্রাবাদ চৌমুহনী (কর্ণফুলী মার্কেটের বিপরীতে) আলহাজ্ব মো. ইউসুফ মিয়ার বাড়িতে। তিনিতো এখন নেই।
: কে এই ইউসুফ মিয়া?
: তিনি একজন অতিসাধারণ মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অসাধারণ হয়ে ওঠেছিলেন। তাঁর বাড়ির নাম পীরবাড়ি। এই বাড়ির ছেলে ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পীরবাড়ির প্রতিজন মানুষ ১ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ভাবে দেশ প্রেমিক বাঙালির ভূমিকায় ছিলো। ৩১ মার্চের দিন থেকে এলাকার মানুষ আতংকের মধ্যে পড়েন। বিশেষ করে সেসময় পাকিস্তান নৌবাহিনী চৌমুহনী মসজিদ ও সাধারণ বীমা ভবনে তাদের স্থাপনা তৈরি করে। মানুষজন সেদিন থেকেই মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দেন। নৌবাহিনীর সদস্যরা এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে যদিও রাস্তায় তখন কোন বাঙালির অবস্থান ছিলো না। এলাকার মানুষ গোপন গ্রামীণ পথে যে যেদিকে পেরেছেন পালিয়ে চলে যান। কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষ নিজেদের ঘর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পথ পাননি। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন। মে মাসের মাঝামাঝি সময় আগ্রাবাদের (বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ আগ্রাবাদ) গ্রামীণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ শুরু হয়। এই অঞ্চলটা তখন মৌলভী সৈয়দ আহমদ এর নেতৃত্বে খুবই গোপনে মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন শুরু হয়। ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে শহরে আসতে শুরু করেন। যেহেতু এলাকাটি ছিলো শতভাগ গ্রামীণ আবহে। পাকিস্তান বাহিনী তৃণমূলে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। মুক্তিযোদ্ধারা সে সুযোগ গ্রহণ করে গড়ে তোলেন অনেকগুলো আশ্রয় কেন্দ্র। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। যেমন-
১. মুক্তিযোদ্ধাদের নানা পরিচয়ে রাখা হতো। থাকা খাওয়া ও নিরাপত্তার বিষয়টি ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও আশ্রয়দাতারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বাড়ির মা-বোনদের ভূমিকা ছিলো গৌরবের। সম্মানহানীর ভয় ছিলো বেশি।
২. অস্ত্র সংরক্ষণ কেন্দ্র ছিলো আলাদা। পারতপক্ষে যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয়ে থাকতেন সেসব স্থানে অস্ত্রের ভাণ্ডার রাখতেন না। শতভাগ নিরাপদ গৃহ বা কবরস্থানে বিশেষ পদ্ধতিতে অস্ত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো।
৩. প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্র, অস্ত্র সংরক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থান থেকে পাহারায় থাকতেন।
এজন্য অবশ্য প্রয়োজনমতে গেরিলা গোয়েন্দা নিয়োগ করা হতো।
উল্লেখিত প্রক্রিয়ার সাথে ইউসুফ মিয়া গোপনে যুক্ত হন। নিজ পীরবাড়ির ঘরে অস্ত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মাঝে মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে বাড়ির পেছন দিয়ে আসতেন। পরামর্শ করতেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেতেন। দিনের আলোতে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা খুব একটা চলাচল করতেন না। পীরবাড়ির সামনে দিয়ে হালিশহর রোড। সে পথ দিয়ে চলাচল করতো পাকিস্তান বাহিনীর ছোট বড় গাড়ি। তাছাড়া ততোদিনে বিহারির ছেলেরা পুরো এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াতে শুরু করে। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, মে মাসের ১৭ তারিখে আনন্দীপুর মীর সুলতানের বাড়ির বাংলা ঘরে ৭ জন বাঙালি তরুণ মৌলভী সৈয়দ আহমদ, মোহাম্মদ হারেস, আবু সাঈদ সরদার, আবদুর রউফ, শেখ দেলোয়ার, মীর সুলতান, আবদুল মোনাফ কোরান শপথ করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। পরে অবশ্য সালিম উল্লাহ, জালাল উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, মঈন উদ্দিন খান বাদলসহ আরো অনেকে যুক্ত হয়েছিলেন। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইউসুফ মিয়া মুক্তিযুদ্ধের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। একসময় তাঁর বাড়িতে পাকিস্তান বাহিনী ঘেরাও করে, তারা বাড়িতে প্রবেশ করে প্রায় প্রতিটি কক্ষ তল্লাসি চালায়। এসময় বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ ছিলেন না। সৈন্যদের মধ্যে বালুচ সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো বেশি। তাই তারা বাড়ির আরো ভেতরের কয়েকটি কক্ষ তল্লাসি না করে বের হয়ে যায়। সেদিন যদি এই সৈন্যরা বাড়ির ভেতরের গোডাউন, লাকড়ি রাখার ঘর তল্লাসি করতো তাহলে বাড়ি বৃদ্ধ ও শিশুরা কেউই প্রাণে বাঁচতেন না। কারণ
১. বিশেষ গোপন কক্ষে ছিলো অস্ত্রের ভাণ্ডার।
২. ছিলো অনেকগুলো গুলি রাখার বাঙ।
৩. বিস্ফোরক দ্রব্য।
৪. বিভিন্ন প্রচারপত্র।
এই বাড়ির মুরুব্বি ছিলেন হাজী সুলতান আহমদ, হাজী বশির এবং হাজী জামাল আহমদ। এই বাড়ির ছেলে দেলোয়ার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ঘাতক বাহিনীর হামলার পর ইউসুফ মিয়া আশ্রয় নেন পাশের মির্জা আহমদ মিয়ার বাড়িতে। এসময় ১২ বছরের হাসিনা বেগম সেবা দিয়ে লুকিয়ে রাখেন তাঁকে। বাড়িটি ক্যাপ্টেন ডা. শামসুল আলমের বাড়ি। বর্তমানে সাংবাদিক আলী আব্বাসের বাড়ি নামেও পরিচিত।
: কেন এই তথ্যগুলো তুলে ধরেছি?
: কারণ তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। কিন্তু এই মানুষটির নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই। তিনিতো কোনদিন গেজেটে নাম তোলার জন্য তদবির করেননি, কোন ফরম পূরণ করেননি। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেননি। যদিও তিনি আমৃত্যু ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুসারি। কোন সুযোগ গ্রহণ করেননি। তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো ১১ ডিসেম্বর ২০০৯। সেদিন তাঁর জানাজা হয়েছিলো দেওয়ানহাট ফায়ার ব্রিগেড মাঠে। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড ক্ষোভ ও প্রতিবাদী হন তাঁকে সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য। প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়েন কারণ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি গেজেটে নেই। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও যুক্তির মুখে প্রশাসন তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এই বীরযোদ্ধার এতো অবদানের পরও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাননি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এটা তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. ইউসুফ মিয়া কি পেতেন পারেন না? মুক্তিযুদ্ধে তৃণমূলে কাজ করতে গিয়ে জানতে পেরেছি অনেকে বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার তথ্য, যাঁরা স্বীকৃতি পাওয়ার শতভাগ যোগ্যতা রাখেন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।