দুদকের মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের জামিন নামঞ্জুরের পাশাপাশি তার স্ত্রীর নামে থাকা পাথরঘাটা এলাকায় দুই কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৬ তলা বাড়িসহ ৪ কোটি ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৭৯ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে পৃথক শুনানিতে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন দুদকের সরকারি কৌসুলী অ্যাডভোকেট মাহামুদুল হক মাহমুদ। তিনি বলেন, সকালে আদালতে আসামিদের পক্ষে করা জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। এছাড়া আসামির চিকিৎসা প্রদানের আবেদনের বিষয়ে আদালত বলেছেন- এটা আদালতের কোনো বিষয় না। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে জেল কোড অনুযায়ী আসামিকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
দুদুকের পিপি মাহমুদুল হক মাহমুদ বলেন, একই দিন আদালতে দুদকের পক্ষ থেকে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পত্তি ক্রোকের একটি মিস মামলা (নং-৩২/২০ইংরেজি) করা হয়। পরে আদালতের শুনানিতে আসামিদের অবৈধভাবে উপার্জিত ৪ কোটি ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৭৯ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনার ফলে আসামিদের সম্পত্তি ক্রোক করার ব্যাপারে দুদকের আর কোনো বাধা নেই বলে জানান তিনি। তবে গতকাল আদালতের শুনানিতে আসামি প্রদীপ কুমার দাসকে আনা হয়নি বলে জানান দুদকের আইনজীবীরা।
দুদকের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু আজাদীকে বলেন, আসামি প্রদীপ কুমার দাস ও তার স্ত্রী চুমকি কারণ একে অপরের সহযোগিতায় ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে চুমকির নামে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৫ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৪ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এসব সম্পদের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। এসব সম্পত্তি ক্রোক করার ব্যাপারে আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন আসামিদের সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।
দুদকের দেয়া তথ্য জানিয়েছে, আসামিদের অবৈধভাবে উপার্জিত স্থাবর সম্পদের মধ্যে কোতোয়ালী পাথরঘাটা এলাকায় এক গণ্ডা তিন কড়া দুই কন্ট চার দন্ত পরিমাণ জায়গায় ৬ তলা ভবন চুমকি কারণের স্বামী প্রদীপ কুমার দাসের অবৈধ অর্থে নির্মাণ করা হয়েছে। জায়গাসহ ১৪৫০ বর্গফুট আয়তনের ওই ভবনটির মূল্য পড়েছে ২ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৭’শ টাকা। পাঁচলাইশ থানাধীন পশ্চিম ষোলশহর মৌজার অধীনে ৬ গণ্ডা ১ কড়া ১ দন্ত জমি চুমকি কারণের নামে বায়না থাকা জায়গাটির মূল্য দেড় কোটি টাকা। এরমধ্যে ১ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্য পরিশোধ করা হয়েছিল। বায়না অবশিষ্ট বাকী ছিল ১০ হাজার টাকা। ওই জমির ওপর গড়ে তোলা সেমিপাকা ঘরের মূল্য ৭ লক্ষ টাকা। দুদক ১ কোটি ৩৬ লাখ ৯২ হাজার ৬’শ টাকার অবৈধভাবে উপার্জিত ওই সম্পত্তির মূল্য দেখিয়েছে। এছাড়া চুমকির নামে কক্সবাজার সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ঝিলংজা মৌজার অধীনে ৭৪০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। ওই ফ্ল্যাটটির মূল্য ১২ লাখ ৫ হাজার ১৭৫ টাকা। আসামিরা ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৪ টাকার অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন বলে জানান দুদকের আইনজীবীরা। এরমধ্যে ২০১৩ সালে ক্রয় করা ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার বর্তমান মূল্যের একটি পুরাতন মাইক্রোবাস, একই সময় ক্রয় করা ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার মূল্যে একটি প্রাইভেট কার ও বেসিক ব্যাংক লিমিটেড আসাদগঞ্জ শাখার একটি ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ টাকা অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।
এর আগে গত ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার সম্পদ ও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে দুদকের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে চুমকি কারণকে ১ নম্বর আসামি ও প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর আসামি করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানি লন্ডারিং আইন, ২০১২ এর ৪ (২), ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। গত ২৭ আগস্ট আদালতে দুদকের এই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন সিনহা হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে কক্সবাজার কারাগারে থাকা প্রদীপ কুমার দাশকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর আবেদন করেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর আদালত দুদকের দায়ের করা মামলায় সিনহা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত টেকনাফে বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেন। ওইদিন আদালত প্রদীপের উপস্থিতিতে এই নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে একই সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে দুটি পিটিশন দাখিল করেছেন। একটিতে আসামির জামিন আবেদন, অন্যটিতে আসামির শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে তাকে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করা হয়েছে। গতকাল ২০ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত দিনে আসামিদের পক্ষে এই দুটি আবেদনের ওপর আদালত শুনানি করেছেন। তবে দুদকের মামলা দায়েরের পর থেকে চুমকি পলাতক রয়েছেন।
দুদকের আইনজীবীরা জানান, আগামী ১৩ অক্টোবর মামলার মূল ধার্য্য তারিখ রয়েছে। ওইদিন আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা ও আসামিকে হাজিরের কথা রয়েছে। প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮) বোয়ালখালী উপজেলার সরোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ লাল দাশের ছেলে। অন্যদিকে একই এলাকার বাসিন্দা তার স্ত্রী চুমকি কারণ (৪৫)।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে দুদক’র তদন্ত কমিটি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত শুরু করেন। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হলেও চুমকি তা জমা দেন ২০১৯ সালের ১২ মে।