এ যেন ‘জেন্টলমেন্ট এগ্রিমেন্ট’। নিজেদের কাজের সুবিধার্থে সময় ভাগ করা আছে; কৌশলেও আছে ভিন্নতা। অভিযান চালাতে গিয়ে রিকশা, কেউ আবার সিএনজি টেক্সি, মোটর সাইকেল কিংবা মাইক্রোবাস ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সদস্যরা ধরা পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অন্য টিম। আর এভাবেই নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি গ্রুপ। তাদের নামেও আছে ভিন্নতা। কোনো গ্রুপের নাম টানা পার্টি, কোন গ্রুপ পরিচিত সালাম পার্টি নামে; আছে ধাক্কা পার্টি থেকে ভুয়া পুলিশ-ডিবি পর্যন্ত। নামে কী আসে যায়, কাজ তাদের একটাই, ছিনতাই। নগরজুড়ে ছিনতাইয়ের শিকার মানুষের অভিযোগ-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্তরিক হলে এদের দাপট কমতে বাধ্য। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার অভাব নেই। ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলাগুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয় না। এ কারণে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে আসামিরা অল্প কদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে যায়। তবে সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তাগণ ছিনতাই কিংবা অজ্ঞান-মলম পার্টির দৌরাত্ম্য আগের তুলনায় বেড়ে গেছে এ কথা মানতে নারাজ। ছিনতাই প্রবণ স্পট এবং ছিনতাইকারীদের সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে নগরীতে অভিযান জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর।
কমিশনারের নির্দেশনায় কাজ চলছে জানিয়ে কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, নগরীর প্রতিটি থানাকে তালিকা অনুযায়ী ছিনতাইকারীসহ সব ধরনের অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন স্যার। এছাড়া নতুন সক্রিয় হওয়া দুর্বৃত্তদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে। যেসব ছিনতাই প্রবণ স্পট আছে সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ টহল আছে।
ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ আজাদীকে বলেন, পুলিশের টহল দলের পালাবদলের সময়টা বেছে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। তবে নগরবাসী কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই এই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারীদের হাতে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে আহত করে ছিনতাইয়ের ঘটনা কম ঘটছে। অস্ত্র ঠেকিয়ে বেশি ছিনতাই হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীতে নিত্যনতুন কৌশলে সকাল-সন্ধ্যা-রাতে সমানে ছিনতাই হচ্ছে। সিএনজি টেঙি নিয়ে ছিনতাইকারীদের একটা গ্রুপ ভোর ৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ছিনতাই করে বেড়ায়। পেশাদারী এই অপরাধী চক্রটির এক সদস্য সিএনজি চালক। যাত্রীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে টেঙিতে যাত্রী ওঠায়। পরে ওই টেঙিকে অনুসরণ করে আরও দুটি সিএনজি টেঙি। সব টেঙিতেই চালক ও যাত্রী বেশে থাকে অপরাধীরা। সুযোগ বুঝে গাড়ি নষ্ট হওয়ার ভান করে কোনো নির্জন জায়গাতে টেঙি থামানো হয়। এরপর পেছনে থাকা টেঙি থেকে টানা পার্টির সদস্যরা বেরিয়ে এসে প্রথম টেঙির যাত্রীর কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নেয়।
আরেকটি গ্রুপ কাজ করে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। তারা সিএনজিতেও আসে, আবার মোটর সাইকেলেও আসে। মূলত রিকশারোহী নারী টার্গেট করে তারা। রিকশার পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে মোটর সাইকেলের পেছনের আরোহী ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় ব্যাগ।
কখনও কখনও পরিচিত ব্যক্তির ভাব করে লোকজনকে থামিয়েও ছিনতাই হচ্ছে। উচ্চস্বরে সালাম দিয়ে হঠাৎ মাঝপথে গতিরোধ করে রিকশা যাত্রীর। প্রাণ বাঁচাতে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন নীরবেই তাদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। হাঁটার পথে আকস্মিক কয়েকজন যুবক ‘মামু কেমন আছেন’ বলে ঘিরে ধরছে পথচারীকে। এরপর অস্ত্র কিংবা ছুরি দেখিয়ে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। কখনও আবার রিকশা থামিয়ে চালককে মারধর শুরু করছে কয়েকজন যুবক। নিরপরাধ রিকশা চালকের ওপর নির্যাতনে বাধা দিতে গেলে অস্ত্র তাক করা হচ্ছে যাত্রীর দিকে। মুহূর্তের মধ্যে কেড়ে নেয়া হচ্ছে যাত্রীর টাকা-পয়সা।
আবার কয়েকটি গ্রুপ ব্যাংক খোলার দিন অবস্থান নেয় ব্যাংকের অদূরে। বেদী (সোর্স) জানিয়ে দেয় টার্গেট কে, টাকা তার কোথায় রাখা আছে। ওই ব্যক্তি বের হলেই ভুয়া পরিচয়ে ডিবি সেজে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়, টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে অর্ধেক পথে নামিয়ে দেয়।
এদিকে নগরীর ছিনতাই প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে, তালিকা ধরে অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু পুলিশের অভিযান শুরু হলে ছিনতাইকারীরা পুরোনো এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকা বেছে নেয়। ছিনতাইকারীদের অভিনব কৌশলের ফাঁদে পড়ে পুলিশের অভিযান ব্যর্থ হয়। ফলে ছিনতাই প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়ে। ছিনতাইকারীরা এখন নগরের নতুন নতুন স্পটে ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরনো স্পটের সামান্য দূরে গিয়ে নতুন ছিনতাই স্পট গড়ে তুলছে তারা।
বর্তমানে ছোট ছোট অসংখ্য গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে নগর জুড়ে। ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বাকলিয়া থানার ওসি নেজামউদ্দিন। তিনি আজাদীকে বলেন, মনে করেন কোন গ্রুপের দুই তিনজন গ্রেপ্তার হলো, তাতে গ্রুপের সদস্য তো কমে যায়। তখন গ্রুপ লিডার অন্য গ্রুপ থেকে সদস্য টেনে নেয়। তাদের গ্রুপে টানা হয় যারা গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের দায়িত্ব নিপুণ দক্ষতায় পালন করতে পারবে। তিনি আরো বলেন, পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন নতুন গ্রুপ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় সবক’টি অপরাধের আশি শতাংশ ঘটাচ্ছে নতুন অপরাধীরা, যারা পেশাদার অপরাধীদের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে দারিদ্রতা, মাদকের চাহিদা মিটানোসহ নানা কারণে। আর বাকি ২০ শতাংশ করছে পেশাদার অপরাধীরা।
থানা পুলিশের দাবি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অভাবে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তিরা জানান, পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো তেমন পাত্তা দেয় না। তাছাড়া থানা-আদালত ছোটাছুটি করতে হবে-এমন আশঙ্কায় ছিনতাইয়ের শিকার বেশিরভাগ মানুষ হয়রানি ও ঝামেলার আশঙ্কায় মামলা করেন না। ফলে ছিনতাইয়ের মামলা কম হচ্ছে।
আবার কেউ কেউ মামলা করতে গেলেও থানা তা নেয় জিডি হিসেবে। ফলে ছিনতাইয়ের প্রকৃত হিসাব পুলিশের কাছেও থাকে না। শুধু তাই নয়, পুলিশের তালিকায় শতাধিক ছিনতাইকারীর নাম আছে। তবে বর্তমানে তাদের অবস্থা কি এবং নতুন করে কারা ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য নেই। পুলিশের দাবি, ছিনতাইয়ে যারা জড়িত হচ্ছে তাদের অনেকে ভাসমান। এক জায়গা থেকে ছিনতাই করে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়।