সংসারে কতখানি কমেপ্রামাইজ করতে পারলেন তার উপরই সুখ নির্ণয় ও নির্ভর করবে। যদি নির্দয়ভাবে কেবল ভোগকারী হোন, নিজের পছন্দ রুচি অপরের ওপর চাপিয়ে দেন কিংবা সকলের মতামত আপনার মতের নিচে চাপা পড়ে তবে সম্পর্কে, দাম্পত্যে কিংবা রাজত্বে সুখের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নিজের দু’টো ইচ্ছা লুকিয়ে রেখে সঙ্গীর দু’টো চাওয়া জিতিয়ে দিলে তবেই ভালোবাসা পাওয়ার পথ সুগম হবে। সবকিছু ইচ্ছামত আদায়ের অভ্যাস মানুষের মন থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। অবজ্ঞা–অবহেলা এবং উপেক্ষার দানবীয়তা কত ভয়ানক হতে পারে তা বিচ্ছেদের যন্ত্রণা জানায়। পাশাপাশি থেকেও, হাতে হাত রেখেও যদি মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি না হয়, মন যদি মনের জন্য টান অনুভব না করে তবে সে সম্পর্ক মরে যেতে শুরু করেছে।
জমে থাকা কথা শোনার সময় না হলে, চোখের ভাষা পড়ে নেওয়ার ইচ্ছা না দেখালে কিংবা মান–অভিমানের গভীরতা খুঁজে তা না ভাঙালে সম্পর্কের মাঝে দেয়াল উঠতে শুরু করে। কেবল রাগ দেখালে ব্যস্ততার ছল শোনালে এবং জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়া মানুষটির যত্ন না নিলে মনের যে দূরত্ব আড়ে–আড়ে বাড়ে তা পাশাপাশি থাকার ব্যবধান গড়ে দেয়। যে সুখ ঘরে থাকে তা উপেক্ষা করে রাজ্যে রাজ্যে সুখের খোঁজে হন্যে হলে তা মিলবে না। অবসর বের করে মুখোমুখি বসতে হবে, হাত ধরে জোছনার বুকে হাঁটতে হবে এবং পাহাড়–নদী–সমতলে সুযোগ খুঁজে ছুটতে হবে। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যখন সঙ্গীর ইচ্ছাকে সম্মান জানানো হবে, আলোচনা করে ফয়সালা করার বাসনা তীব্র হবে তখন সুখের ডাক্তার ও চিকিৎসা ঘরেই মিলবে।
সম্পর্কের ভিত বিশ্বাস। যদি অবহেলাতেও এই বিশ্বাস একবার নষ্ট হয়ে যায় তবে সেটা ফিরিয়ে আনা, পুনর্জন্ম দেওয়া মুশকিল। একবার বিশ্বাস নষ্টের পর শতেক বিশ্বাসের কাজ করলেও সন্দেহ মরে না। কাজেই দু’জনের প্রতি দু’জনার বিশ্বাস যাতে না ভাঙে– প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। অযাচিত সন্দেহ প্রবনতা থাকলে তা অচিরেই দূর করতে হবে। মনের মধ্যে সন্দেহের বাতিক ঢুকলে তা সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট করে। সুন্দর সময়ের জন্য, সুখের আবাসের জন্য কিংবা পারস্পরিক সম্মান অটুট কল্পে গল্পেও সন্দেহের বীজ রাখা যাবে না। কোনভাবে সন্দেহের চারা যদি গজিয়েও যায় তবে শক্ত হাতে সেটা সমূলে উপড়ে দিতে হবে। সম্পর্কেও সন্দেহ সুখ বিনষ্টের কারণ। কাজেই মনকে সন্দেহ ক্রিয়া থেকে বারণ করতে হবে।
যতটুকু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকবে আত্মতৃপ্তির ভিত ততটা মজবুত হবে। ছাড় না দিয়ে কোন সম্পর্কে কেউ জিততে পারে না। কেবল ভোগের চিন্তা মানুষকে কুকুর স্বভাবের মত উন্মত্ত করে। অকারণে অভিযোগে পাহাড় তোলা, কিছু মনমতো না হলে চিল্লাপাল্লা করা এবং কথায় কথায় অযাচিত অশ্লীল শব্দের ব্যবহার সম্পর্ককে চরম নাজুক পর্যায় পৌঁছে দেয়।
বরং কিছু পাওয়ার আশায় এবং দেওয়ার প্রশ্নে লাজুক থাকা জরুরি। তাড়াহুড়ো এবং হুড়োহুড়ি সম্পর্কের মাঝে ছন্দপতন অবশ্যম্ভাবী করে। সাধ্যের অতিরিক্ত দরদ দেখালে, ভালোর মুখোশের আড়ালে অভিনয় চাপালে কিংবা মিথ্যাভিনয় ধরা পড়লে+ তখনই সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটবে। কাজেই সুখের জন্য সাচ্চা দরদ, মুগ্ধতার স্বভাবে পরিপূর্ণ মরদ হওয়া জরুরি। ভুলের ক্ষমা করতে না জানলে সে সম্পর্ক লাস্টিং করে না।
সুসম্পর্কের জন্য ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলোতে ক্ষমা করা জরুরি। কখনোই যদি জেদের কাছে ইচ্ছা হেরে যায়, মিথ্যার মধ্যে সুন্দর চাওয়া মরে যায় তবে মনের পাওয়া দূরত্বের হবে। অভিমান জমিয়ে জমিয়ে সুখের পথ বন্ধুর করা ঠিক নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও একবার ছাড় দিয়ে, হেরে গিয়ে কিংবা নত হয়েই দেখুন। এতে আসলে সম্পর্ক জিতে যায়। সুখের স্রোত তীব্র হয়। কেবল লাভের চেয়ে যখন দান কিংবা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ হয় তখনই সম্পর্কের এবং দাম্পত্যের চারদেয়াল দৃঢ় হয়। এই একজীবনে সুখই সব। সেই সুখভরা মুখের জন্য জীবন থেকে ক্ষতিকর নুড়িগুলো বাছাই করে তীরে নিক্ষেপ করতে হবে। অহংকার, দম্ভ যাতে না থাকে, অবিশ্বাস এবং অভিনয় যাতে ঘিরে না ধরে তবেই শান্তি। বিশ্বাসের সিঁড়ি পেরিয়ে এবং উপেক্ষাযোগ্য অভিযোগ এড়িয়ে মিলনমন্দিরে মানুষের সাথে দেখা হোক– এই আশার জন্ম হোক। সুখের জন্য যে সদিচ্ছার দরকার সেটার কাছে যেন বারবার ফিরে যাই।